ভারতীয় দূতাবাসের অর্থায়নে নগরের ধোপাদিঘির পাড়ে নান্দনিক ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। উন্মুক্ত পরিবেশে হাঁটা ও ধোপাদিঘি রক্ষায় আধুনিক স্থাপত্যে তৈরি এই ওয়াকওয়ে নির্মাণের পর নগরবাসীর প্রশংসা কুড়ায়। এই ওয়াকওয়ে নানা বয়সী লোকজন প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় নিয়ম করে হাঁটেন।
কিন্তু দুই মাস আগে হঠাৎ করে এই ওয়াকওয়ে ৫ বছরের জন্য লিজ দিয়ে বসে সিসিক কর্তৃপক্ষ। মেসার্স ইষাণ এন্টারপ্রাইজ ৬০ লাখ টাকায় পাঁচ বছরের জন্য এই ওয়াকওয়ে ইজারা নেওয়ার পর দৃষ্টিনন্দন এই দিঘির দুপাশে ৮টি দোকান তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। এখানে বসেছে চটপটি, ফাস্টফুড, চায়ের দোকান। গেট পাস হিসেবে নেওয়া হচ্ছে ৫ টাকা করে ফি। এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
উন্মুক্ত এই ওয়াকওয়ের সামনে মোটরসাইকেল পার্কিং করলেই ২০ টাকা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া দোকানের ময়লা আর্বজনা ধোয়া হচ্ছে দিঘির পানিতে। আর দোকানকে কেন্দ্র করে নানা মানুষের ভিড়ের কারণে উন্মুক্ত পরিবেশে হাঁটার পরিবেশ এখন নাই বললে চলে। ওয়াকওয়ের মধ্যে বিভিন্ন পণ্যের দোকান বসিয়ে এর পরিবেশ নষ্ট করারও অভিযোগ উঠেছে।
ধোপাদিঘির পাড় ওয়াকওয়েতে নিয়মিতভাবে প্রতিদিন হাঁটেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। বুধবার রাতে ওই ওয়াকওয়েতে হাঁটতে গিয়ে তিনি এমন নোংরা পরিবেশ দেখেন।
এ অবস্থায় উন্মুক্ত ওয়াকওয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) বিকেলে ‘হাঁটার উন্মুক্ত পরিবেশ চাই’ প্ল্যা-কার্ড হাতে নিয়ে এককভাবে প্রতিবাদী অবস্থান নেন সলেট জেলা জজ আদালতের সাবেক পিপি মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ।
‘হাঁটার উন্মুক্ত পরিবেশ চাই’ এমন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ধোপাদিঘির পাড় ওয়াকওয়েতে দাঁড়িয়েই প্রতিবাদ করেন। এসময় তার সঙ্গে সংহতি জানান এই ওয়াকওয়েতে হাঁটতে আসা আরও বেশ কয়েকজন নাগরিক।
এর মধ্যে ওয়াকওয়ে এলাকার বাসিন্দা সিলেটের বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি সারোয়ার হোসেন আবদাল, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি, সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট কিশোর কর, নাগরিক মৈত্রী সিলেটের সভাপতি অ্যাডভোকেট সমর বিজয় সী শেখর, সুজিত বৈদ্য ছাড়াও স্থানীয় অনেকে প্রতিবাদে অংশ নেন।
এসময় মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পৃথিবীর কোথাও উন্মুক্ত পার্ক বা ওয়াকওয়ে এভাবে বাণিজ্যিকিকরণ করা হয় না। ভারতের আর্থিক সহায়তায় প্রায় পরিত্যক্ত এই ধোপাদিঘি নবরূপে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু দৃষ্টিনন্দনভাবে তৈরির অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই এটিকে লিজ প্রদানের মাধ্যমে এর ভেতরে চটপটি, ফুচকা এবং জুস ও চায়ের দোকান তৈরি করা হয়েছে। এতে এই এলাকায় এখন আর হাঁটার পরিবেশ নেই। সাধাণ মানুষজন আর হাঁটাচলা করতে পারে না। তিনি এই ওয়াকওয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার না করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানান।
জানা গেছে, ৬০ লাখ টাকা চুক্তিতে ইশান এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য এই ওয়াকওয়ে ইজারা দিয়েছে সিটি করপোরেশন। ইজারা নেওয়ার পর ওয়াকওয়ের ভেতরে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের অন্তত ৮ থেকে ১০টি দোকান বসিয়েছে তারা। এ ছাড়া ওয়াকওয়েতে প্রবেশে সবার কাছ থেকে ফি নেওয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ইশান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী খালেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, আমরা দুই মাস হলো এটি ৬০ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছি। ইজারার সব চুক্তিই আমরা মেনে চলছি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর এখানকার পরিবেশ আরও উন্নত হয়েছে।
দিঘির পাড়ে তালাবাসন ধোয়া ও ময়লা আবর্জনা ফেলাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো মানুষ। আমাদেরও ভুল হতে পারে। মিসবাহ আমাদের সিনিয়র রাজনীতিবিদ। আমরা তাদের মতো নেতাদের দেখে রাজনীতি করি। তিনি আজ কেন এরকম একটা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করলেন বুঝতে পারছি না। ভোর ৫টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এই ওয়াকওয়ে সবার হাঁটাচলার জন্য উন্মুক্ত থাকে বলে দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা থেকে ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়। সিসিক ধোপাদিঘিকে নতুন রূপ দেওয়ার পর ভারত সরকার এগিয়ে আসে এর অর্থায়নে। ‘ধোপাদিঘি এরিয়া ফর বেটার এনভায়মেন্ট অ্যান্ড বিউটিফিকেশন’ নামে প্রকল্প গ্রহণ করে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, দিঘিতে পানি ছিল ৩ দশমিক ৪১ একর জায়গাজুড়ে। চারপাশে দখল হওয়া জায়গা উদ্ধারের পর পানির সীমানা বেড়ে কমপক্ষে ৩ দশমিক ৭৫ একরে উন্নীত হয়েছে। নোংরা দুর্গন্ধময় পরিত্যক্ত এই দিঘিকে দৃষ্টিনন্দন রূপ দেওয়া হয়েছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধোপাদিঘিতে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। চারদিকে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বসার জন্য রয়েছে বেঞ্চ। পুকুরে নামার জন্য রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ঘাট। পুকুরের নোংরা পানিকে পরিষ্কার করা হচ্ছে। নৈসর্গবিদের পরামর্শে গাছ লাগানো হবে। স্থাপন করা হয়েছে পাবলিক টয়লেট। ওয়াকওয়েটি গত বছরের ১১ জুন এটি উদ্বোধন করা হয়।
মন্তব্য করুন