কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় সপ্তম শতাব্দীর ঐতিহাসিক চন্ডীমুড়া মন্দিরের জায়গা জোর করে দখল করে দোচালা ঘর নির্মাণ করে ফেলা হয়েছে। এটি একটি প্রত্নতত্ত্ব নির্দশনও। লালমাই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। শনিবার (২১ জুন) সকাল থেকে এ কাজ শুরু করে দুপুরের পরপরই দ্রুত সব শেষ করে ফেলা হয়। ঘর তুলতে ৫০-৬০ জন অংশ নেন।
খবর পেয়ে স্থানীয়দের সাথে নিয়ে বাধা দেন মন্দির কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা। দুপুরে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দুপক্ষের উপস্থিতিতে ঘর সরিয়ে নিতে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন।
রোববার (২২ জুন) সাড়ে ৪ টার পর পুলিশ গিয়ে ঘরটি সরিয়ে নেওয়া শুরু করে। ওই দখল করা ৬ শতক ভূমি নিয়ে মামলা চলছে। বিএস খতিয়ানে ওই ভূমি মন্দিরের নামে দেবোত্তর হিসেবে রয়েছে। তাদের দাবি, তাদের কাছে মালিকানা দলিল রয়েছে।
মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার অনিমেষ দাস জানান, শনিবার ভোর থেকে ৫০-৬০ জন লোক একত্রিত হয়ে ওই জায়গার দাবিদার আব্দুল আলীর নেতৃত্বে দোচালা ঘর তুলে ফেলে। জায়গাটি মন্দিরের প্রবেশদ্বার সংলগ্ন। সঙ্গেই সড়ক। ওই জায়গায় মন্দির কমিটি অস্থায়ী যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছিল, এর ভেতরে রেখেই টিনের দোচালা ঘর তুলে ফেলা হয়।
তিনি জানান, খবর পেয়ে শনিবার তারা সবাই ছুটে যান। ৯৯৯- এ কল দিলে পুলিশ এসে এ কাজে বাধা দেয়। কিন্তু তারা চলে গেলে আবার ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করে। পরে আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যাই। তিনি সবকিছু দেখে ওই ৬ শতক জায়গা দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে মন্দিরের বলে নিশ্চিত হন। শনিবার দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে ইউএও উপস্থিত হন এবং দুপক্ষের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু আদালতে মামলা চলমান তাই ঘর যারা তুলেছেন তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্য ওই স্থাপনা তুলে নিয়ে জায়গাটি আগের অবস্থানে ফিরিয়ে দেবেন। স্থাপনাটি তুলে নেওয়ার পরদিন মন্দির কমিটির অস্থায়ী যাত্রী ছাউনি তুলে নিতেও অনুরোধ করেন। মন্দির কমিটি এতে সম্মত হয়। ওসির উপস্থিতিতে সম্মতি মুছলেকায় স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
রোববার দুপুরের মধ্যে মন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথের পাশে গড়ে তোলা তাদের স্থাপনা তুলে জায়গা আগের অবস্থায় খালি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ৬ শতক জায়গার ওপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। জায়গা পূর্বাবস্থায় থাকবে।
আগামী মঙ্গলবার (২৪ জুন) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখে যাবেন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে কিনা। না মানলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্দিরের পেছনের বাসিন্দা প্রয়াত আইয়ুব আলীর বড় ছেলে আব্দুল আলী চলতি বছরের মে মাসে কুমিল্লার আদালতে এ ৬ শতক জায়গার মালিকানা দাবি করে মামলা করেন। আদালত বিবাদী পক্ষ মন্দির কমিটিকে নোটিশ দেয় ও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মন্দির কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে লিখিত জবাব আদালতে দিয়েছেন। ১৩ জুলাই মামলার শুনানির তারিখ রয়েছে।
মন্দিরের সেবায়েত ব্যবসায়ী দীপক সাহা জানান, ২০০৪ সালে আবদুল আলীর পিতা প্রয়াত আইয়ুব আলীর কাছ থেকে মন্দির সংলগ্ন ১৬ শতক ডোবা-জলা ও জায়গা কিনে নেওয়ার সম্মতিতে টাকা পরিশোধ করেন মন্দিরের পুরোহিত আত্মানন্দ গিরি মহারাজ। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি এলাকায় এসে মন্দিরটি পুনরায় চালু করেন। তিনি সংস্কৃত শাস্ত্রের পন্ডিত ও স্কুল শিক্ষক ছিলেন।
২০০৮ সালে আইয়ুব আলী অনেক পীড়াপীড়ির পর ১০ শতকের দলিল রেজিস্ট্রেশন দেন। বাকি এ ৬ শতক রেজিস্ট্রেশন দিতে পারেননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় এ ৬ শতক বিএস খতিয়ানে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড হয়। তাই আইয়ুব আলী দলিল রেজিস্ট্রেশন দিতে পারছিলেন না। ঘটনা জানার পর তারাও আর রেজিস্ট্রেশন চায়নি। এরইমধ্যে আইয়ুব আলী ও আত্মানন্দ গিরি মহারাজ দুজনই প্রয়াত হন। বর্তমানে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের মে মাসে সুযোগ বুঝে আদালতে মামলা করেন প্রয়াত আইয়ুব আলীর ছেলে আবদুল আলী।
পূজা উদযাপন পরিষদ কুমিল্লা মহাগরের সহসভাপতি দিলীপ কুমার নাগ কানাই জানান, চন্ডীমূড়া মন্দিরটি লালমাই টিলা ও সংলগ্ন দুই একর অধিক জায়গায় জুড়ে রয়েছে। সপ্তম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত। বহুবার এর জায়গা লালসার শিকার হয়েছে। এখানে শিবলিঙ্গ ও চন্ডীমার বিগ্রহ রয়েছে। আরএস খতিয়ানের সময় মন্দিরের অনেক জায়গা বেহাত হয়। এ কেনা ১৬ শতক জায়গা মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ডান পাশের জলাশয় ছিল, যা ভরাট করে সমতল করা হয়েছে। উচু টিলায় মন্দির হওয়ায় এখানে একটি অস্থায়ী যাত্রী ছাউনি বা বিশ্রামাগার করা হয়। এটি দখল করে দোচালা ঘর নির্মাণ করে ফেলা হয়েছে।
মন্দিরটি সদর দক্ষিণ, বরুড়া ও লাকসাম উপজেলায় যাতায়াতকারী সড়কের তেমাথায় অবস্থিত। সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত।
রোববার সারাদিন খোঁজাখুজি করেও আবদুল আলীকে পাওয়া যায়নি। মন্দিরের পেছনে তাদের বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য নেই। নিতান্তই গরিব পরিবার। নারীরা পরিচয় দিতেও নারাজ। এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চাননি। পরিবারের কেউ তার মোবাইল নম্বরও দিতে পারেননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারীর দাবি, তাদের দলিল রয়েছে। তাই তারা রেকর্ড সংশোধনী মামলা করেছেন। তবে বিএস খতিয়ানে ভুলবশত দেবোত্তর সম্পত্তি রেকর্ড হয়ে যায়। তবে এর পক্ষে জোরলো কাউকে পাওয়া যায়নি।
মন্দিরের পাশের কনফেকশনারির মালিক মনির হোসেন জানান, এ দীর্ঘদিন ধরেই মন্দিরের জায়গা। একটা ছাউনি আছে। শনিবার দাবিদাররা এসে ঘর তোলে। আমরা জানি বিএস রেকর্ডে দেবোত্তর সম্পত্তি। এভাবেই জেনে আসছি।
সদর দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, যারা ঘর তুলেছে তারা মুচলেকা দিয়ে গেছে রোববার দুপুরের মধ্যে ঘর সরিয়ে ও জায়গা খালি করে দেবে, আগে যেমন ছিল। রোববার দুপুর ৪টার দিকে থানা থেকে পুলিশ পাঠিয়ে ঘর সরানো শুরু করানো হয়েছে। দুপক্ষই সমঝোতা মেনেছে।
সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া খানম কালবেলাকে বলেন, ঘর নিমার্ণের বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিয়েছি। ইক্যুইটির প্রশ্নে মন্দির কর্তৃপক্ষকেও বলছি ছাওনি তোলে জায়গা খালি করে রাখতে। মামলা চলছে। তারা বলেছে তাদের দলিল আছে। তারা রেকর্ড সংশোধনীর মামলা করুক।
রুবাইয়া খানম আরও বলেন, বিএস রেকর্ডে দেবোত্তর সম্পত্তি, মন্দিরের জায়গা। এ ঘটনায় উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রয়েছে। বিষয়টি আমরা ফলোআপ করছি।
মন্তব্য করুন