জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে বড়তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শেষ, চলছে রঙের কাজ। এরইমধ্যে তিনতলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। রঙ মিস্ত্রিকে দিয়ে সেসব ফাটলে মোটা প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টাও করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. তানজিমুল ইসলাম।
এর আগেও এ ভবনটির ওয়াল প্লাস্টার ও মেঝে ঢালাইয়ের কাজে নষ্ট সিমেন্ট ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছিল এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে।
বিষয়টি জানতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেটি রিসিভ হয়নি। পরে উপজেলা প্রকৌশল অফিসকে জানানো হলে তারা জানান কাজ ঠিক আছে, এটা সামান্য ব্যাপার, এটার জন্য কোনো সমস্যা হবে না।
জানা গেছে, ২০২৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) প্রকল্পের আওতায় বড়তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪ তলা ভিত্তির ৩ তলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ১ কোটি ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৫৫৩ টাকার কাজটি পায় নওগাঁর প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. তানজিমুল ইসলাম। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভবন নির্মাণকাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শুরু থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে। এ নিয়ে এলাকাবাসী, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও শিক্ষকরা মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানালে তা আমলে নেওয়া হয়নি। এলাকাবাসী কয়েকবার কাজ বন্ধ করে দিলেও পরবর্তীতে ক্ষমতার জোরে আবারও একইভাবে কাজ করে।
কাজ শেষ না হতেই ভবনের পিলার, ছাদ, দেয়াল, মেঝে ও বেলকনির বিভিন্ন অংশে ফাটল ধরে। পরে রঙ মিস্ত্রিকে দিয়ে ফাটল অংশে রঙের মোটা প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ভবনের রঙের কাজ এবং বারান্দা, সিঁড়ি ও কয়েকটি ঘরের মেঝের প্লাস্টার ফিনিশিং এখনো শেষ করেনি। নিয়মানুযায়ী, ভবনের সকল কাজ শেষ হলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পুরো ভবনের কাজ দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ছাড়পত্র দিলে তবেই ভবন হস্তান্তর করতে পারবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সে সব নিয়ম না মেনেই গত মাসেই ভবন হস্তান্তরের তারিখসহ ফলক বসানো হয়েছে। ফলকে প্রকল্পের নাম, প্রকল্পিত ব্যয়, ভিত্তি, নির্মাণকারী বিভাগসহ হস্তান্তরের তারিখ লেখা রয়েছে। যেখানে হস্তান্তরের তারিখ দেওয়া হয়েছে গত জুলাই মাসের ১৪ তারিখ।
স্থানীয় বাসিন্দা স্বাধীন সরকার বলেন, এ স্কুলের কাজ শুরুর প্রথম থেকে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে কাজ করেছে। আমরা যতবার নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে বাধা দিয়েছি তৎকালীন আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়েছে। যার জন্য পরবর্তীতে কেউ আর তাদের বাধা দিতে পারেনি। শুনেছি নওগাঁর এই ঠিকাদার নাকি আওয়ামী লীগের বড় নেতা, তার প্রভাবে ইঞ্জিনিয়ারও তাদের পক্ষে ছিল। ৫ আগস্টের পর সে ঠিকাদার পালিয়ে আত্মগোপন করলেও তার প্রভাব কমেনি। কয়েকমাস আগে ভবনের ওয়াল প্লাস্টারের কাজ করার সময় নষ্ট সিমেন্ট দিয়ে কাজ করার সময় আমরা বাধা দিই। পরে ইঞ্জিনিয়ার অফিসকে জানানো হলে তারা এসে সে সিমেন্ট সরিয়ে ফেলে এবং ব্যবস্থা নেবে জানায়। এখন আবার ভবনে ফাটল ধরা পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের একজন বলেন, বিদ্যালয়ের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে কাজ করলে আমি বিষয়টি আমি শিক্ষা অফিসে জানাই। তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে হুমকি দেয় যে আমার চাকরি খেয়ে ফেলবে। পরে চোখের সামনে খারাপ কাজ করলেও আমরা আর কেউ বাধা দিতে সাহস করিনি। পরে আওয়ামী লীগের সরকারের পতন হলে ওই ঠিকাদার আর বিদ্যালয়ে আসেনি, তবে তার ম্যানেজার নুর আলম আসেন। এরপরও কোনো কাজ সঠিক না হলে আমরা বললেও তারা গুরুত্ব দেয় না। উল্টো শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মেহেদি হাসান বাবলা কালবেলাকে বলেন, বিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবনের কাজের শুরু থেকেই আমাদের মতামতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ভবন নির্মাণকারক প্রতিষ্ঠানের স্বত্তাধিকারী তানজিমুল ইসলাম প্রথম থেকে কয়েকবার আসলেও ৫ আগস্টের পর তিনি আর আসেননি। তারপর তার ফোন নম্বরটিও বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তার ম্যানেজার নুর আলম সাইটে আসে মাঝে মাঝে। তাদের কোনো সমস্যার কথা বললেও তারা তা সংশোধন করে দিত না। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার কয়েকবার কথাকাটাকাটিও হয়েছে। পরে উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারদের বললে তারা উল্টো সেসব কাজ সঠিক বলে আমাদের বুঝ দেয়।
তিনি বলেন, ভবনের প্লাস্টার কাজে নষ্ট সিমেন্টও ব্যবহার করেছিল। আমরা অভিযোগ জানালে ইঞ্জিনিয়ার অফিস তা সরিয়ে ফেলতে বললে ঠিকাদারের লোক সরিয়ে ফেলে। তবে ওয়াল প্লাস্টারের কাজের ফিনিশিং ভালো হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় উঁচু নিচু হয়েছে। যার ফলে রঙের কাজও ভালো হয়নি। ভবনের টপরুমসহ কয়েক জায়গায় ফাটল ধরেছে। বিষয়টি আমরা শিক্ষা অফিসকে জানালে ইঞ্জিনিয়ার অফিসের লোকজন এসে সেসব ঠিক করে দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে গেছে।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তানজিমুল ইসলামের ফোনে বারবার ফোন করা হলেও তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে তার ম্যানেজার নুর আলমের নম্বরে বারবার কল করা হলেও সেটি রিসিভ হয়নি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দীন কালবেলাকে বলেন, প্রধান শিক্ষক বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। আমি উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারকে জানিয়েছি। তিনি এক/দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব ঠিক করে দেবেন বলে জানিয়েছেন।
উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বলেন, কাজতো আমাদের শেষ। ছোটখাট দু-একটা কাজ আছে সেগুলো করা হচ্ছে। হস্তান্তরের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তবে আমাদের একটা ডেট থাকে। এজন্য আগেই ডেটসহ ফলক বসানো হয়েছে। বিম-কলামের নিচে ওয়াল ওঠালে এইরকম একটু ফাটল নিতে পারে। তবে ওই ওয়াল সরিয়ে নিলেও কোনো সমস্যা হবে না।
উপসহকারী প্রকৌশলী তাহেরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বিদ্যালয় ভবনের যেসব ত্রুটি ছিল আমরা তা ঠিক করে দেওয়ার জন্য ঠিকাদারকে নির্দেশ দিয়েছি। তারা সেসব নিয়ে কাজ করছে।
ঠিকাদারের নম্বরে যোগাযোগ করা যায় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেইন ঠিকাদার তানজিমুল রাজনীতি করত এখন তিনি কোথায় আছেন বা কোন নম্বর ব্যবহার করেন আমরা তা জানি না। আমরা এখন উনার পার্টনার নুর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তবে তার কে যেন অসুস্থ হওয়ায় তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন তাই হয়ত আপনার কল ধরছে না।
ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আল জিনাত কালবেলাকে বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। কোনো গাফিলতি থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন