ঝালকাঠিতে দেশীয় পিস্তল, গুলি ও ফেনসিডিলসহ ‘আটকের’ পর শিশু সন্তানসহ এক নারীকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।
বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার গালুয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কানুদাস কাঠি গ্রামের অভিযান চালিয়ে ওই নারীকে আটক করে বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
ওই নারীর নাম মোসা. রোজিনা বেগম (২৮)। তিনি কানুদাস কাঠি গ্রামের আল আমিনের স্ত্রী। রোজিনার সঙ্গে কারাগারে পাঠানো হয় তার তিন বছরের মেয়ে নুসরাত ফারিয়া মৌকেও। তাদের বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দা শাখা আটক করেছিল।
মায়ের সঙ্গে কন্যা শিশুকে আটক প্রসঙ্গে আদালতে রাজাপুর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) সুরমা আক্তার বলেন, রোজিনার মেয়ের বয়স কম হওয়াতে মায়ের সঙ্গে রাখার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
গত বৃহস্পতিবার জেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এইচ এম ইমরানুর রহমান গ্রেপ্তার আসামিকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মা ও মেয়ে দুজনেই এখন ঝালকাঠি জেলা কারাগারে আছে।
এর আগে এ ঘটনায় বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার ডিএনসি বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার এসআই ইশতিয়াক হোসেন পৃথক মামলা করেন এবং আসামিকে রাজাপুর থানায় হস্তান্তর করেন। এতে রোজিনাকে প্রধান ও তার স্বামী আল আমিনকে দুই নম্বর আসামি করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে পুলিশ মা-মেয়েকে কারাগারে পাঠায়। আল আমিন ঘটনার পর থেকেই পলাতক।
বরিশাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন জানান, সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার সন্ধ্যায় আল আমিনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি দেশীয় পিস্তল, ১০ রাউন্ড তাজা গুলি ও ১৫ বোতল ফেনসিডিলসহ তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে অভিযানের খবর পেয়ে আল আমিন পালিয়ে গেছে।
এদিকে এই অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আসামির স্বজনরা। অভিযানকে সাজানো নাটক বলে অভিহিত করে তারা বলেন, ঝালকাঠি ডিএনসিকে না জানিয়ে বরিশাল বিভাগীয় দলের এ অভিযান কেন?
রোজিনার বাবা বারেক মিয়া বলেন, স্থানীয় তিনটি পক্ষের সঙ্গে তার মেয়ে জামাইয়ের জমি নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিরোধ চলছে। এরই জেরে প্রতিপক্ষরা এই সংস্থাকে কাজে লাগিয়েছে।
থানা হাজতে থাকা অবস্থায় এক ফাঁকে সংবাদকর্মীদের রোজিনা জানান ,বিনা অপরাধে তিনি আটক হয়েছেন। তিনি তার স্বামীর মাদক কারবারের বিষয়ে অবগত নন। ঘরে যে অস্ত্রগুলো ও ফেনসিডিল ছিল তাও তার জানা নেই।
স্বজনদের দাবি, মামলায় মোট তিনজনকে সাক্ষী করেছেন এসআই ইশতিয়াক। এরপর মামলার এজাহারের সঙ্গে সাক্ষীদের বক্তব্যের গরমিল পাওয়া গেছে। সাক্ষীদের মধ্য দুজনের বক্তব্যে রোজিনা অস্ত্র ও মাদক কারবারে জড়িতের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। অভিযানকে ‘সাজানো নাটক’ বলেও দাবি করেন সাক্ষীরা।
অস্ত্র ও মাদক মামলার এক নম্বর সাক্ষী মোস্তফা বেপারী বলেছেন, ‘বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার একটি দল বুধবার বিকেলে আল আমিনের বাড়িতে এসে খড়ের গাদা থেকে একটি দেশে তৈরি পিস্তল, ১০ রাউন্ড গুলি ও ১৫ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে, যা উপস্থিত সবাই দেখেছেন। সন্ধ্যার পরে ঘরে তল্লাশি করা হবে বলে আমাকে ডেকে নেয়। আল আমিনের বসতঘরে কাপড় রাখার ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ার খুলে অস্ত্র, গুলি ও ফেনসিডিল বের করা হয়। খড়ের গাদা থেকে উদ্ধার অস্ত্র ও মাদক কীভাবে ঘরে গেল, তা আমি জানি না। পরে শুনেছি, আমাকে এ মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে।’
তিন নম্বর সাক্ষী রাব্বি হাওলাদার বলেন, ‘বুধবার বিকেলে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে গোয়েন্দারা অস্ত্র ও ফেনসিডিল দেখান। সেগুলো আল আমিনের ঘরের সিঁড়িতে সাজানো ছিল। উপস্থিত লোকজন জানান, এগুলো খড়ের গাদায় পাওয়া গেছে। এর পর দোকানে ফিরে আসি। পরে সন্ধ্যায় আবারও ঘরে তল্লাশির কথা বলে ডেকে নেন এবং এক পর্যায়ে ঘর থেকে অস্ত্র, গুলি ও ফেনসিডিলগুলো বের করে আনেন তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানতে চাই, তাহলে তো দুটি পিস্তল উদ্ধার হলো। পরে খেয়াল করে দেখি, সিঁড়ির সেই পিস্তলই ঘর থেকে বের করেছেন গোয়েন্দারা। এ সময় আমি সাক্ষী দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে টাকা দিতে চান। ফোন দিলেই আদালতে যেতে হুমকি দেন এবং খরচাপাতি দেবেন বলে জানান। ওই ঘর দূরে থাক, বাড়িতেও অস্ত্র, গুলি কিংবা ফেনসিডিল থাকতে পারে, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
রোজিনার বড় বোন আসমা বেগম, ভাবি মনোয়ারা বেগম, মামা সিদ্দিকুর রহমান, বাবা বারেক মিয়া, ভাই জুয়েল মিয়াসহ স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রথমে তো অভিযানে বসতঘরে কোনো অস্ত্র, গুলি ও ফেনসিডিল পায়নি। বাড়ির উঠানের দক্ষিণ পাশের খড়ের গাদার মধ্য থেকে এসব উদ্ধার করা হয় এবং ঘরের সিঁড়িতে সাজিয়েও রাখে। কিন্তু সন্ধ্যার পর সব উল্টে যায়। পরে দেখা যায়, মামলায় ঘর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র-মাদক উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। অভিযানের সময় কাউকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এমনকি নারীদের মারধর ও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। কেউ ষড়যন্ত্র করে ফাঁসাচ্ছে কিনা, তা তদন্তের দাবি জানান স্বজনরা। একইসঙ্গে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান তারা।
অস্ত্র আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজাপুর থানার এসআই মামুন হোসেন জানান, তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। মামলার অপর আসামি আল আমিনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
রাজাপুর থানার ওসি পুলক চন্দ্র রায় জানান, রোজিনার নামে আগের কোনো মামলা নেই। তবে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ঝালকাঠি সদরে একটি ও রাজাপুর থানায় দুটি মাদক মামলা রয়েছে।
এই ব্যাপারে বক্তব্য জানতে বাদী এসআই ইশতিয়াক হোসেনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি। তবে আগের দিন তিনি বলেছিলেন, ‘আল আমিন যশোরের বেনাপোল থেকে মাদক এনে বিভিন্ন স্থানে চড়া দামে বিক্রি করেন। তিনি এলাকায় বড় মাপের মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। স্বামীর অনুপস্থিতিতে রোজিনা এ কারবার চালান। ক্রেতা সেজে তার কাছ থেকে আমরা মাদক নিয়েছি। কারও প্রভাবে নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পরিচালক পরিতোষ কুমার কুণ্ডু বলেছেন, ‘রাজাপুর থানা বিষয়টি তদন্ত করছে। আশা করছি, সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে এবং আদালতে উভয় পক্ষ ন্যায়বিচার পাবে। আসামি ও তাদের স্বজনরা নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণে অনেক কথা বলতেই পারেন, এসব আমরা আমলে নিচ্ছি না।’
তবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোজিনার পরিবার থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং নগদের মাধ্যমে ১৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। রোজিনার ভাই জুয়েল মিয়া বলেন, ডিএনসি বরিশাল বিভাগীয় গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ফারুক নামে একজন বুধবার রাত থেকে বহুবার ফোন দেন এবং ২০ হাজার টাকা চান। পরে ধারদেনা করে ১৬ হাজার টাকা পরদিন সকালে তাদের দেওয়া নাম্বারে পাঠান জুয়েল।
তিনি আরও বলেন, ‘টাকা দিলেও তার বোন ছাড়া পাননি, আর অভিযানে জড়িত ব্যক্তিরা ছাড়া এতসব তথ্য অন্য কারো জানার কথা নয়।’ পুরো বিষয়টি ডিএনসির কারসাজি বলে দাবি করেন জুয়েল। বিষয়টি তিনি তদন্তের দাবি জানান।
মন্তব্য করুন