‘আমার বাবাকে আনো…’ চার বছরের ছোট্ট ফাহাদের শেষ ইচ্ছেটুকুও পূরণ হলো না। মৃত্যুর পরও জায়গা হলো না নিজের দাদা-দাদির কবরের পাশে। চাচাদের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত দাফন করতে হলো অন্যত্র, বাবার ফসলি জমিতে।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার নারান্দী ইউনিয়নের গাংকুলপাড়া গ্রামে হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি ঘটেছে। মৃত শিশুটির নাম মো. ফাহাদ মিয়া (৪)। তার বাবা আল মামুন বাবুল মিয়া সৌদি আরবে কর্মরত এক প্রবাসী।
জানা যায়, চার বছরের ছোট্ট ফাহাদের শুধু একটা অনুরোধ ছিল তার বাবাকে দেখার। হঠাৎ হার্টের সমস্যা থেকে শ্বাসকষ্ট সেখান থেকে হাসপাতাল। চার দিন ধরে ছোট্ট শিশুর বুকের ভেতর লড়াই চলেছিল। হার্টের একটি অপারেশনের পর শেষ পর্যন্ত হার মানল। পরপারে পাড়ি জমায় ফাহাদ।
দেশে না থেকেও পরিবারের জন্য প্রতিদিন কষ্টে উপার্জিত অর্থ পাঠাতেন বাবুল মিয়া। কিন্তু রোববার (১২ অক্টোবর) সকালে যখন ফোনে জানানো হলো— তার একমাত্র সন্তান আর নেই, তখন সব ভেঙে পড়ল তার জীবনে। ভিডিও কলে ছেলের নিথর মুখ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। কেবল বলতে পারছিলেন- ‘ওকে আমার বাবা-মায়ের কবরের পাশে শুইয়ে দাও… ও আমার জান…।’ কিন্তু সেই প্রার্থনাটুকুও পূরণ হয়নি।
মৃত্যুর পর পরিবারের পক্ষ থেকে ফাহাদকে দাদা-দাদির কবরের পাশে দাফনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু চাচাতো চাচারা কবর খোঁড়ার কাজ থামিয়ে দেন। তাদের দাবি, জায়গাটি এজমালি (যৌথ সম্পত্তি), সেখানে আর নতুন কবর দেওয়া যাবে না।
স্থানীয়দের ধারণা, রাস্তার পাশের ওই জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এ বিরোধের সূত্রপাত। ছোট্ট ফাহাদ হয়তো বুঝতেও পারেনি- মাটি, যা তার শেষ আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল, সেটি নিয়েও লড়াই চলবে তার মৃত্যুর পর।
ঘটনাস্থলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়রা ৯৯৯-এ ফোন দেন। পুলিশ এসে দুই পক্ষকে বুঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরে স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ফাহাদকে তার বাবার নিজের জমিতে দাফন করা হয়।
প্রবাসী বাবার বুকভরা স্বপ্ন এখন মাটির নিচে। দূর প্রবাসে বসে হয়তো এখনো তিনি নিজের ছেলের সেই শেষ অনুরোধ শুনছেন- ‘আমার বাবাকে আনো…।’
চাচাতো ভাই হাকিম বলেন, বর্তমান জায়গাটা এজমালি (যৌথ) জায়গা। দাদা এখানে ছয় গন্ডা জায়গা পাবে। এখানে আমরা সবাই পাই। কিন্তু এখন জায়গাটি তাদের দখলে, এজন্য তারা বাধা দিয়েছে। এখানে কবর দেওয়ার জন্য বাবা-চাচা ও এলাকার অনেকেই তাদের রিকোয়েস্ট করেছে কিন্তু তারা রাজি হয়নি। উল্টো মার্ডার হবে তবুও এখানে কবরস্থ করতে দেবে না বলে হুমকি দিয়েছে। হার্টের অপারেশনের লাশ বাধ্য হয়ে অন্য জায়গায় কবর দিয়েছি।
স্থানীয় ৭নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, আমরা অনেক বুঝিয়েছি— এটা তো একটা শিশু! কিন্তু চাচাতো চাচারা শুনল না। শিশুটির দাদা-দাদির কবরের পাশে মাত্র একটুখানি জায়গা দিলেই হতো।
প্রবাসী বাবার বন্ধু রায়হান আকন্দ বলেন, মানবিকভাবে ওদের জায়গা দেওয়া উচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত নিজের জমিতেই কবর দিতে হলো। ভাবতেই কষ্ট হয়— একটা শিশুর জন্য এমন আচরণ!
ফাহাদের ফুফু পারুল আক্তার কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, আমার ভাই বিদেশে, বাড়িতে কেউ নেই। কতটুকু জায়গা লাগতো একটা বাচ্চার জন্য! দাদা-দাদির পাশে দিলেই বা কার কী ক্ষতি হতো?
এদিকে অভিযুক্ত চাচা সোহেল মিয়া প্রবাস থেকে ফোনে তার ভাইকে নির্দেশ দেন কবরস্থানে বাধা দিতে। তার ভাই আসিফ বলেন, ভাই বলেছে ওখানে কবর না দিতে। জায়গাটা এজমালি, তাই বাধা দিয়েছি।
পাকুন্দিয়া থানার এসআই আতিকুর রহমান রাসেল জানান, দাফন নিয়ে দুপক্ষের বিরোধের কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছিল। পরে উভয়পক্ষের সম্মতিতে শিশুটিকে তার বাবার নিজস্ব জমিতে দাফন করা হয়।
পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর আমি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধির সাথে কথা বলেছি। তারা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেছে।’
মন্তব্য করুন