সাত লাখ টাকা ঘুস দাবির একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালের পর রাজশাহীর চারঘাট মডেল থানার ওসি মাহবুবুল আলমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় তাকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। এর আগে ওসি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে এক গৃহবধূর কাছে ৭ লাখ টাকা ঘুস দাবির একটি অডিও ফাঁস হয়।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) ও মিডিয়া সেলের মুখপাত্র মো. রফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত শনিবার বিকেলে ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ রাজশাহীর পুলিশ সুপারের কাছে ঘুস চাওয়ার বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এর সঙ্গে ঘুস চাওয়ার ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের কথোপকথনের একটি রেকর্ডও সংযুক্ত করা হয়েছে। একই অনুলিপি সরাসরি ও ডাকযোগে পুলিশের আইজিপি, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির কাছেও পাঠানো হয়েছে।
অভিযোগকারী গৃহবধূর নাম সাহারা বেগম। তিনি চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়নের চামটা গ্রামের আব্দুল আলিম কালুর স্ত্রী। মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কারাগারে কালু। জেলা ডিবি পুলিশের ওসি তাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। কালু গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শলুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এতে স্থানীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এর জেরে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন সাহারা বেগম।
লিখিত অভিযোগে সাহারা বলেছেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগ করতে গেলে গৃহবধূ সাহারা বেগম ও তার ছেলে রাব্বিকে নিজের বেডরুমে ডেকে নেন ওসি মাহবুবুল আলম। প্রথমে ওসি তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেন। এরপর কথা বলতে শুরু করেন।
ফাঁস হওয়া ওই অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে গাইবান্ধা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমি তার কথা ছাড়া কারও কথা শুনি না।’ চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেওয়ার কারণে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সমালোচনা করেন ওসি।
এরপর বলেন, ‘দুই লাখ টাকা দেন, কালকেই ডিবির ওসিকে বদলি করে দেব।’ এরপর গৃহবধূ সাহারা বেগমকে ওসি বলেন, ‘আপনার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করে গেছে (ওসির বিরুদ্ধে এসপি অফিসে অভিযোগ করেছিলেন)। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার কমে ছাড়াতে পারব না।’
এরপর ওসি বলেন, ‘এখনো তোমার গায়ে আঁচড় দেইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছে। কালকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সে রকম সময় নয় যে, কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া কিছু নেই।’
ওসি আরও বলেন, ‘মুক্তা (চারঘাটের মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারবে না, শুভ (ছাত্রলীগ নেতা) অ্যাকশন নিতে পারবে না। তোমরা ৫ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের চালান দিয়ে দেব। থাকি না থাকি ওদের সাইজ করব। তোমরা বাইরে থেকে ব্যবসা (মাদক ব্যবসা) করবে।’
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আতিকুর রেজা সরকার আতিকের আবারও সমালোচনা করে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচনের আগে শুভকে ধরতে পারব না। কথা সব ভেঙে বলব না। কথা সব হয়ে গেল; যদি আতিকের বদলি চাও ২ লাখ টাকা দাও। কালকেই আতিকের বদলি হয়ে যাবে।’
চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুলকে আরও বলেন, ‘৫ লাখ আর ২ লাখ মোট ৭ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো। আতিক বাদ, ওই দুজনকে (মুক্তা ও শুভ) ট্যাকেল দেওয়ার দায়িত্ব আমার। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে মন্ত্রীকে বলে ওই দুইজনকে ধরে অ্যারেস্ট করে চালান করে দেব। আমার সব ওপরের লাইন। যে টাকা দিবা এই টাকাই ওপরে কাজ করবে।’ অডিওতে গৃহবধূ সাহারা বেগমের ‘সুন্দর চেহারা’ নিয়েও মন্তব্য করতে শোনা যায় ওসিকে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করা হলেও ওসি মাহবুবুল আলম ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সাহারা বেগম বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। চারঘাট এলাকায় তার সোর্সের মাধ্যমে অনেক মাদক র্যাব-পুলিশ জব্দ করেছে। গত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তিনি সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এরপর থেকে এলাকার মুক্তা, শুভ ও সাব্বিরের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ বাধে। এর জের ধরে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করায় তারা।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) ও মিডিয়া সেলের মুখপাত্র মো. রফিকুল আলম বলেন, ‘ওই নারীর লিখিত অভিযোগ আমরা এখনো পাইনি। তবে অভিযোগের সঙ্গে দেওয়া একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এজন্য তদন্তের স্বার্থে ওসিকে চারঘাট মডেল থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।’
মন্তব্য করুন