

‘এত শীতে মানুষ কেমনে বাঁচে, পাতলা ক্যাঁথা গাদ্দিয়া আইতোত ঘুমই আইসেনা।’ রাস্তার পাশে চেয়ারে বসে আগুন পোহায়ানো ৬৫ বছর বয়সী লাইলী বেগম কষ্ট নিয়ে বলছিলেন কথাগুলো। পৌষের শুরুতেই উত্তরের সীমান্তঘেঁষা নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় তীব্র শীতের দাপট শুরু হয়েছে। শীতের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ, নিম্ন আয়ের পরিবার এবং তিস্তা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের বাসিন্দারা।
গত এক সপ্তাহ ধরে অব্যাহত শীতের সঙ্গে ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়া যোগ হওয়ায় দিনের বেশির ভাগ সময় সূর্যের দেখা মিলছে না। ফলে হাট-বাজার ও রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি অনেকটাই কমে গেছে। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ডিমলায় চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
এদিন সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উপজেলা সদরসহ পশ্চিম ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, খগাখরিবাড়ি, টেপাখরিবাড়ি ও খালিশা চাপানি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের কারণে শ্রমজীবী মানুষ কাজের অভাবে অলস সময় কাটাচ্ছেন। অনেক জায়গায় শীত নিবারণের জন্য খড়কুটো জোগাড় করে আগুন পোহাতে দেখা গেছে। কোথাও কুয়াশা কিছুটা কমলেও শীতের তীব্রতা একটুও কমেনি।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুস সবুর জানান, মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকালে ডিমলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা আরও কমতে পারে।
উপজেলার শুটিবাড়ি থেকে ঢাকাগামী জোছনা পরিবহনের চালক আব্দুল জলিল মোল্লা বলেন, ‘৪০ বছর ধইরা গাড়ি চালাই। এইবার কুয়াশা খুব বেশি। রাতে গাড়ি চালানো অনেক ঝুঁকির। ঠিক সময় গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। দিন যাইতেছে, শীত আর কুয়াশার কষ্টও বাড়তেছে।’
এদিন বেলা ১০টার দিকে রাস্তার পাশে একটি চেয়ারে বসে আগুন পোহাচ্ছিলেন ৬৫ বছর বয়সী লাইলী বেগম। তিনি বলেন, ‘এত শীতে মানুষ কেমনে বাঁচে, পাতলা ক্যাঁথা গাদ্দিয়া আইতোত ঘুমই আইসে না। রোদও ওঠে না যে গা গরম করিম। ঠান্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছু। শুননু সরকার নাকি কম্বল দেয়ছে, হামার এইঠে আসবে কি না, মুই জানোনা।’
শীতের মৌসুম শুরু হতেই বাড়ি বাড়ি জ্বর, কাশি ও ডায়রিয়াসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ৬০ বছর বয়সী আমেনা বেগম বলেন, ‘কয়দিন ধইরা জ্বরে ভুগতেছি। তার ওপর এই ঠান্ডা। বাঁচাই মুশকিল। গায়ে দেওয়ার মতো একটা গরম কাপড়ও নাই।’
ডালিয়া নতুন বাজার এলাকায় পাথরের সাইটে কাজের অপেক্ষায় থাকা বাইশপুকুর গ্রামের শ্রমিক লাল মিয়া বলেন, ‘কুয়াশা আর শীতের কারণে সাইটে কাজ বন্ধ। দুদিন ধইরা আসি, আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরি।’
ডালিয়া নতুন বাজারে লালশাক বিক্রি করতে আসা বাইশপুকুর গ্রামের হোসেন আলী বলেন, ‘তীব্র শীত ও কুয়াশার কারণে বাজারে ক্রেতা কমে গেছে। এতে আগের তুলনায় বেচাকেনাও অনেক কম।’
সদর ইউনিয়নের ভাটিয়াপাড়া এলাকার অটোভ্যানচালক আব্দুল জলিল বলেন, ‘ভোরে বের হওয়া যায় না। কুয়াশার কারণে সকালে রাস্তায় নামাই কষ্ট। পরে বের হলেও যাত্রী খুব কম পাই।’
উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের তিস্তা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে শীতের প্রভাব আরও বেশি। ছিন্নমূল মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহালেও গরম কাপড়ের অভাবে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মীর হাসান আল বান্না বলেন, মৃদু শৈত্যপ্রবাহের কারণে রবি ফসল ও বোরো ধানের বীজতলায় বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উপজেলার মাঠে সরিষা, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফসল রয়েছে, যেগুলোর পরিচর্যা ঠান্ডার কারণে ব্যাহত হচ্ছে।
শীত ও শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এতে ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর চাপ বেড়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ৭০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যাই বেশি।’
মন্তব্য করুন