গাজীপুরে ৫টি সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লড়াই জমে উঠেছে। ফলে তীব্র হচ্ছে নৌকার সঙ্গে ট্রাকের টক্কর। নির্বাচনী মাঠে প্রচার প্রচারণা যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের তীর। সংসদ সদস্য হিসেবে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে বিরোধ বাড়ছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। অনেক জায়গায় বিক্ষিপ্ত হামলা, পোস্টার ছেঁড়া,ভাঙচুর এবং প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে গাজীপুর-২ আসনের নৌকার প্রার্থী, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। স্থানীয়রা বলছেন, এই নির্বাচনে অন্তত তিনটি আসনে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। গাজীপুর ২,৩ ও ৫ আসনে হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র।
জানা গেছে, গাজীপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে এ আসন। এ আসনে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল। সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ড এ আসনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সমর্থন দিয়েছেন রেজাউল করিম রাসেলকে। সিটি নির্বাচনের জাহাঙ্গীর ম্যাজিককে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আশা করছেন রেজাউল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী তার দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং কালিয়াকৈরে তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভোটারদের কাছে তুলে ধরছেন।
গাজীপুর-২ আসনে নৌকার প্রার্থী যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছেন নিজ দলের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক প্রতীকের মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন ও ঈগল প্রতীকের মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। সিটির ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে গাজীপুর-২ আসন। এখানেও জাহাঙ্গীর ম্যাজিক কাজে লাগাতে চাচ্ছেন কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন। তার পক্ষে জাহাঙ্গীর আলম ও তার সমর্থিত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী মাঠে নেমেছেন। ইতোমধ্যে ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীর প্রচার অভিযানে একাধিকবার বাধা প্রদানের অভিযোগ পাওয়া গেছে। টঙ্গীর মাছিমপুরে ট্রাক প্রতীকের নির্বাচনী অফিসে হামলা ও টঙ্গী সরকারি কলেজ মাঠে প্রবেশের সময় গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এবারের নির্বাচনে প্রার্থী নন। তবে তিনি কাজ করছেন তিনটি সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক হিসেবে। প্রতিদিনই প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন তিনি, চাইছেন ভোট। তবে ভোট প্রার্থনা ও সমর্থনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধে জাহিদ ও জাহাঙ্গীর। এখন একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় সমালোচনা করে বক্তব্য রাখছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তিসংক্রান্ত জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তার শাস্তি ও বহিষ্কার দাবিতে যে কয়জন জোরাল ভূমিকা রাখেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জাহিদ আহসান। জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একপর্যায়ে হারান মেয়র পদ। পরে অবশ্য দল তাকে ক্ষমা করে। তবে সেখান থেকেই তাদের বিরোধের শুরু। সিটি নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বাধা দেওয়া হয় নির্বাচনী প্রচারণায়। সিটি নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের মা বিজয়ী হলে জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধ আরও তীব্র হয়। এখন সংসদ নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি গণসংযোগ ও সমাবেশে জাহাঙ্গীর আলম ও জাহিদ আহসান একে অপরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিচ্ছেন।
গত মঙ্গলবার টঙ্গীর ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগে জাহিদ আহসানকে ইঙ্গিত করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মানুষের সেবা করার জন্য আমরা চারবার ভোট দিয়ে তাকে (জাহিদ আহসান) নির্বাচিত করেছিলাম। কিন্তু তিনি মানুষের সেবা না করে টঙ্গীকে মাদক দিয়ে সয়লাব করে দিয়েছেন। মানুষ এখানে কলকারখানা করতে গেলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। তারা চাচা গ্রুপ বানাইছে, ভাবি গ্রুপ বানাইছে, ভাইয়া গ্রুপ বানাইছে, ফুফু গ্রুপ বানাইছে। তাদের এই পরিবারতন্ত্র থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই।
গণসংযোগে জাহাঙ্গীর আলমকে ইঙ্গিত করে নৌকার প্রার্থী জাহিদ আহসান বলেন, কিছু মানুষ সব সময়ই ষড়যন্ত্র করে। আমার নির্বাচনী এলাকাও এর বাইরে নয়। সিটি করপোরেশনের টাকাকে কাজে লাগিয়ে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সাহেব বিভিন্ন প্রলোভন দিচ্ছেন, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যা নির্বাচনী আচরণবিধিতে পড়ে না। এক প্রতিষ্ঠানের টাকা দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন করবেন তা হতে পারে না।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
গত বৃহস্পতিবার টঙ্গী সরকারি কলেজ মাঠে বিজয় দিবসের পথসভা ও গণসংযোগ করার কথা ছিল আলিম উদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের। কিন্তু ফটকে তালা থাকায় তাদের সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ফটকের তালা ভেঙে মাঠের ভেতর প্রবেশ করে পথসভা করেন।এ ঘটনায় জাহিদ আহসানের বিরুদ্ধে প্রচারে বাধার অভিযোগ তুলে গত রোববার সংবাদ সম্মেলন করেন কাজী আলিম উদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম। সংবাদ সম্মেলনের কয়েক ঘণ্টা পর আলিম উদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে গাজীপুর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ওই কলেজের এক শিক্ষার্থী। স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, জাহিদ ও জাহাঙ্গীরের বিরোধের কারণে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী বা ভোটাররা ভাগ হয়ে গেছেন। পাশাপাশি জাহিদ ও জাহাঙ্গীর একে অপরকে উদ্দেশ করে উসকানিমূলক বক্তব্য, বিষোদ্গার বা পাল্টাপাল্টি অভিযোগে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
এদিকে, গাজীপুর -৩ আসনে নৌকার প্রার্থী রুমানা আলীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইকবাল হোসেন সবুজ। এ ছাড়া গাজীপুর-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ছেন নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাকসুর সাবেক ভিপি-জিএস ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাবেক এমপি আখতারউজ্জামানের সঙ্গে। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আখতারউজ্জামান। এ আসনের সঙ্গেও গাজীপুর সিটির তিনটি ওয়ার্ড যুক্ত রয়েছে। আখতারউজ্জামানও সমর্থন পাচ্ছেন জাহাঙ্গীর আলমের। গাজীপুর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী তাজউদ্দীন কন্যা বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন নিজ দলের এবং নিজ পরিবারের সদস্য তাজউদ্দীন আহমেদের ভাগিনা কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা আলম হোসেন।
স্থানীয়রা বলছেন, গাজীপুর-১, ২ ও ৫ আসন সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এখানে ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে পারে জাহাঙ্গীর ম্যাজিক। ফলে সবার নজর জাহাঙ্গীর ও তার অনুসারীদের নিয়ে।
আর্কাইভ 
| ০৯ জুন ২০২৫ 
