প্রকৃতির সঙ্গে পুরাকীর্তি যাদের সমানভাবে আকর্ষণ করে তাদের আসতে হবে সাতক্ষীরার কলারোয়ার সীমান্ত ঘেঁষা সোনাবাড়িয়ায়। মধ্যযুগীয় নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সোনাবাড়িয়াজুড়ে। এমনই এক পুরাকীর্তি মঠবাড়ি মন্দির গুচ্ছ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
কলারোয়া উপজেলা সদর থেকে ৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়িয়া গ্রামে ঐতিহাসিক এই প্রত্নস্থলটির অবস্থান। প্রায় পৌনে ৪০০ বছরের পুরোনো ৬০ ফুট উঁচু টেরাকোটা ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এই মঠ-মন্দির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ঐতিহাসিক মঠ-মন্দিরটি এখনই সংস্কার ও সংরক্ষণ করা না গেলে একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা নিশ্চিতই বলা যায়।
২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর এই মঠ-মন্দির সরেজমিনে পরিদর্শন করেন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তী। ৯ বছর আগের ওই পরিদর্শনকালে ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে ছিলেন দৈনিক কালবেলা’র প্রধান সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক আবেদ খান, সংসদ সদস্য (সাতক্ষীরা-১) অ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহসহ অনেক বিশিষ্টজন। সে সময় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারসহ অতিথিরা ঐতিহাসিক এই স্থাপনা সংস্কার ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, খুলনা জাদুঘর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে এটি পরিদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো সেভাবে নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক মো.মোশারফ হোসেনের লেখা ‘প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা’ বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, এ মন্দিরটি ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। যেটি সতীশ চন্দ্র মিত্রের বইয়েও উল্লেখ রয়েছে। এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় এর ত্রিতলবিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির। এটিই ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এর সঙ্গে লাগোয়া রয়েছে দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির। এই মন্দিরগুচ্ছের দক্ষিণে একটি অসম বাহুবিশিষ্ট চৌকো দিঘি আছে। শ্যামসুন্দর মঠের নিচের তলা ১০.৮২ মিটার/৩৫ ফুট-৬ ইঞ্চি বর্গাকার ভিত পরিকল্পনায় নির্মিত। এর দ্বিতলের মাপ ১০ মিটার/৩২ফুট-১০ ইঞ্চি ৯.৯৮ মিটার/৩২ ফুট-৯ ইঞ্চি এবং ত্রিতল ৭.৪৬ মিটার/২৪ ফুট-৬ ইঞ্চি ৭.১৬ মিটার/২৩ ফুট-৬ ইঞ্চি। ফলে মন্দিরটি একটি পিরামিড আকৃতি ধারণ করেছে। দক্ষিণমুখি এই মন্দিরের নিচের তলার ভেতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ৬.১৪ মিটার/২০ ফুট-২ ইঞ্চি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এবং ১.৩২ মিটার/৪ ফুট-৫ ইঞ্চি চওড়া একটি মণ্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে প্রকোষ্ঠ রয়েছে। তবে পূর্বাংশের কোঠাটির পেছনে রয়েছে একটি অলিন্দ, যেখানে দ্বিতল ভবনে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। ধারণা করা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল। দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণমুখী কোঠা। এর পরিমাপ ২.২৮ মিটার/৭ ফুট-৬ ইঞ্চি ১.৯৮মিটার/৬ ফুট-৬ ইঞ্চি। ত্রিতল ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়ামাটির ফলক রয়েছে।
মোশারফ হোসেনের ওই জরিপ বইয়ে আরও বলা হয়েছে, শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে ৪৫.৭ সেন্টিমিটার/১ ফুট-৬ ইঞ্চি উঁচু নিরেট মঠ। এর প্রত্যেক তলার ছাদপ্রান্ত ধনুকের মতো বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধ্বমুখী গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রত্ন রয়েছে। এটি তাই ‘নবরত্ন স্মৃতি মন্দির’। নবরত্ন বা শ্যামসুন্দর মঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি দক্ষিণমুখী মন্দির আছে। এটি ‘দুর্গা মন্দির’ নামে পরিচিত। শ্যামসুন্দর মন্দিরের গা ঘেঁষে পূর্বমুখি মন্দিরটিতে ৯১.৪৩ সেন্টিমিটার/৩ ফুট উঁচু একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। এর ওপর একটি ভাষ্য ফলক পাঠোদ্ধার অনুপযোগী অবস্থায় সংস্থাপিত আছে। এর ছাদ চৌচালা, কার্ণিশ ধনুকাকারে বাঁকা এবং কোণগুলো কৌণিক। এটি ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ নামে পরিচিত। মন্দিরগুচ্ছের সবকটি ইমারতে ২২.৮৫ সেন্টিমিটার, ২০.৩১ সেন্টিমিটার, ২.৫৩ সেন্টিমিটার পরিমাপের ইট ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। বর্তমানে এ মন্দিরগুচ্ছ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মঠের পাশে আরও ৮টি (মতান্তরে ১০টি) মন্দির ছিল।
অনেকের মতে, রামহংস পরমানন্দ এক সময় মন্দিরগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন। জানা যায়, মঠ মন্দিরগুচ্ছের অল্প দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে সেটির পাকাঘাটে ব্যবহৃত ইটের সঙ্গে ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ এর ইটের মিল পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা হয়, পুকুরটি একই সময়কালের নিদর্শন। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক পুকুরটি বিষমবাহুর আকার ধারণ করেছে। বিশিষ্ট লেখক প্রফেসর আবু নসরের লেখা ‘কলারোয়া উপজেলার ইতিহাস’ বইতেও এই প্রাচীন মঠটি সম্পর্কে অনুরূপ তথ্য-উপাত্ত উল্লিখিত রয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যেন মন্দিরগুচ্ছের সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়। এটাই তাদের চাওয়া। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএন) রুলী বিশ্বাস কালবেলাকে জানান, তিনি একাধিকবার সোনাবাড়িয়ার এই ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পরিদর্শন করেছেন। এটি রক্ষার্থে সংস্কার ও সংরক্ষণ করা অতি প্রয়োজন।
সোনাবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান বেনজির হোসেন হেলাল, উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সম্পাদক সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তীসহ এলাকার অনেকেই বলেছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা সংস্কার ও সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ পুরাকীর্তিপ্রেমী মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
মন্তব্য করুন