প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৮৯ সালে। যে ভূমিকম্পে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল আশপাশের সব এলাকা। এতে পশ্চিমের বাউন্ডারি ওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সগৌরবেই দাঁড়িয়েছিল মসজিদটি। অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জের পিরোজপুরে। নাম সোনা মসজিদ।
সুলতানি আমলে নির্মিত এ মসজিদের গম্বুজগুলোতে সোনার গিল্ড করা ছিল বলে এর নাম সোনা মসজিদ। ঐতিহাসিক এ মসজিদটির মাত্র ৩ কিলোমিটার উত্তরেই রয়েছে সোনা মসজিদ স্থলবন্দর। দিন-রাত পাথরসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহন চলাচল করায় কম্পন সৃষ্টি হয় তাতে। যদিও কম্পনমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে, তবুও শিগিগিরই একটি বাইপাস সড়ক করা না হলে কম্পনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সুলতানি আমলের ঐতিহাসিক এ অপূর্ব নিদর্শন।
জানা যায়, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল বংশের রাজাদের সময় থেকে প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম শাসকরা গৌড় অধিকারের পরেও বাংলার রাজধানী ছিল এটি। পরে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাংলার রাজধানী বছর তিনেকের জন্য স্থানান্তর করা হয় পাণ্ডুয়ায়। পরে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে আবার ফিরে আসে তা গৌড়ে। প্রাচীন এ জনপদ বাংলার রাজধানী ছিল বলে বহু অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলে। সুলতানি ও মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদ, মাদ্রাসাসহ নানা মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের মধ্যে সোনা মসজিদ এক অপূর্ব নিদর্শন।
ফটকের ওপর স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে মুনসুর ওয়ালি মুহাম্মদ কর্তৃক নির্মিত হয় এটি। আয়তকারভাবে নির্মিত এ মসজিদটির বাইরের দৈর্ঘ্য ২৫ এবং প্রস্থ ১৬ মিটার এবং অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ২১ দশমিক ৮৮ এবং প্রস্থ ১২ দশমিক ৩৫ মিটার। উভয় পাশ পাথর দ্বারা অলংকৃত ৩ দশমিক ১২ মিটার পুরুত্বের দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল পাতলা ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে। মসজিদে ১১টি প্রবেশ পথের মধ্যে পূর্ব দেয়ালে ৫টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে ৩টি করে। পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে কারুকার্যময় পাথরে তৈরি চমৎকার ৫টি মেহরাব। মসজিদের উত্তর ও পশ্চিম কোণে অলংকৃত স্তম্ভের ওপর রয়েছে ‘বাদশা-কা-তক্ত’ বা সুলতান বা উচ্চপদ মর্যাদা বিশিষ্ট ব্যক্তির নামাজের স্থান বা লেডিস গ্যালারি মতান্তরে মহিলাদের নামাজের স্থান। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, সুলতানি আমলে বিচারকার্য পরিচালনা হতো মসজিদভিত্তিক। তাই ওই স্তম্ভে বসে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন কাজী কিংবা বিচারকরা। মসজিদের চারকোণে রয়েছে অষ্টকোণাকৃতির ৪টি টারেট বা মিনার। ছাদের ওপরে রয়েছে ১৫টি গম্বুজ। যারমধ্যে ১২টি অর্ধগোলাকৃতির ও ৩টি চৌচালা আকৃতির।
জনশ্রুতি রয়েছে, গম্বুজগুলো এবং প্রধান মেহরাবটি সোনায় মোড়ানো থাকায় রোদে তা সোনার মতো জ্বলজ্বল করত বলে এর নাম হয়েছে সোনা মসজিদ। তবে মসজিদটি থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গৌড় দুর্গে নির্মিত সোনা মসজিদের তুলনায় আকারে ছোট হওয়ায় এটি ’ছোট সোনা মসজিদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ইংরেজ আমলে সেই সোনা খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে কথিত রয়েছে।
নকশাঙ্কিত স্থাপত্যকলা ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের বিচারে গৌড়ের রত্ন হিসেবে পরিচিত এ মসজিদের সামনের চমৎকার খিলানযুক্ত তোরণটি অতিক্রম করলেই চোখে পড়বে এর দেয়ালের বহিরাংশে পাথরের ওপর পোড়ামাটির ফলকের অনুকরণে লতাপাতা, ফুল, ঝুলন্ত শিকল ও ঘণ্টা ইত্যাদির নান্দনিক সব অলংকরণ, যা পর্যটকদের বিমোহিত করে সহজেই।
এর দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধী। যা আকৃষ্ট করবে যে কাউকে। স্মরণ করিয়ে দিবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। প্রধান ফটকের বাইরে রয়েছে দুটো দোতলা বিশিষ্ট কবরের পাশাপাশি কালোপাথরে মোড়ানো বেশ কয়েকটি কবর। তবে তাতে কোনো শিলালিপি না থাকায় কবরগুলো কাদের তা জানা যায় না।
প্রধান ফটকে থাকা পর্যটকদের পরিদর্শন বইতে দেখা যায়, ঐতিহাসিক এ অপূর্ব নিদর্শন দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন নানান বয়সের হাজারো মানুষ। তারা বলছেন, এতদিন শুধু নাম শুনেছি ঐতিহাসিক এ সোনা মসজিদের। আজ স্বচক্ষে এ মুসলিম স্থাপত্যশিল্প দেখে বিমোহিত আমরা।
ঐতিহাসিক এ মুসলিম স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে ইমাম মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। ১৮৮৯ সালের প্রলঙ্করী ভূমিকম্পে আশপাশের সবকিছু বিলীন হলেও আল্লাহর রহমতে টিকে ছিল মসজিদটি। এখন স্থলবন্দর থেকে ভারী যানবাহন চলাচল করায় কম্পন সৃষ্টি হয় এতে। তাই ঐতিহাসিক এ মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের রক্ষায় প্রয়োজন একটি বাইপাস সড়ক।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, সোনা মসজিদের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শাহিনুজ্জামান খান কালবেলাকে বলেন, ভূমিকম্পে পশ্চিমের বাউন্ডারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখন ভারী যানবাহন চলাচল করায় তাতে কম্পন সৃষ্টি হয় বলে এলাকাটিকে কম্পনমুক্ত এলাকা ঘোষণা করেছে সড়ক বিভাগ। তবে কম্পনমুক্ত ঘোষণা করলেই তো হবে না। ঐতিহাসিক এ অপূর্ব নিদর্শনকে রক্ষায় দরকার একটি বাইপাস সড়ক।
মন্তব্য করুন