ছিনতাই মামলায় জামিনে থাকা দুই আসামি ও তাদের আত্মীয়কে থানায় আটকে নির্যাতনের পর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। গত ৬ জুন শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী আবু জাফর ঠান্ডু। তিনি জাজিরা উপজেলার নাওডোবা বাজারের ব্যবসায়ী।
অভিযুক্তরা হলেন শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। এ ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার।
এদিকে এ ঘটনায় ইতোমধ্যে পদ্মা দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে ক্লোজ করে জেলা পুলিশ লাইনে পদায়ন করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ব্যবসা-সংক্রান্ত বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছে শাহীন আলম শেখ ও সাদ্দাম চোকদারের মধ্যে।
পুলিশ, ভুক্তভোগী ও মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২১ মে দুপুরে পদ্মা সেতু জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সোহাগ পরিবহন থেকে শাহীন আলম শেখ ও সেকেন্দার মাদবরকে জোর করে নামিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা বিদেশি ডলার, মোবাইল ফোনসহ অন্য জিনিসপত্র নিয়ে যায় সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ ১০-১২ জন। এ ঘটনায় ২৩ মে ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা করেন শাহীন আলম শেখ। টাকা, ডলারসহ মোট ২১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এ মামলায় গত ২৯ মে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন সাদ্দাম-বকুলসহ তিন আসামি। পরদিন রাতে বকুল, সাইদুল শেখ ও আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বন্ধু আলমগীর চোকদারের বাসায় যান সাদ্দাম। তথ্য পেয়ে সে রাতেই ওই বাসায় হাজির হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির, ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারীসহ ১০-১২ পুলিশ সদস্য। এ সময় সাদ্দাম তাদের জামিনের কাগজ দেখালে সেটি ছিঁড়ে ফেলেন রাসেল। সেখানেই সাদ্দাম ও বকুলকে লাঠি, কাঠ, হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। প্লাস দিয়ে তাদের হাত ও পায়ের নখও তুলে ফেলা হয়। এমনকি পানি চাইলেও করা হয় অমানুষিক নির্যাতন, যা পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত চলে।
৩১ মে সকালে ওই চারজনকে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর নিচে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখান থেকে সাদ্দাম-বকুল ও সাইদুল-আনোয়ারকে পৃথক স্থানে নেওয়া হয়। এ সময় তারা সাদ্দাম-বকুলকে বলেন, সাইদুল-আনোয়ারকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতে তাদের ৭২ লাখ টাকা দিতে হবে। সেখানে সারাদিন রেখে ওই রাতে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় এনে আবারও নির্যাতন করা হয় তাদের। সারারাত চলে সে নির্যাতন।
অন্যদিকে, দাবিকৃত টাকার জন্য বকুলের স্ত্রী, দুই বছরের সন্তান, বাবা রশিদ চোকদার, মা রমেলা ও চাচাতো ভাই আবু জাফর ঠান্ডুকে থানায় এনে সারারাত আটকে রাখা হয়। রাতব্যাপী নির্যাতন করা হয় ঠান্ডুকেও। একপর্যায়ে আত্মীয়-স্বজনরা পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকা দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসির কাছে।
পরে ১ জুন বিকেলে সাদ্দাম, বকুলসহ চারজনকে শরীয়তপুর আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিচারক তা নামঞ্জুর করেন। অবশেষে গত ৬ জুন বিকেলে সাদ্দাম, বকুলসহ চারজনই আদালত থেকে জামিন পান।
ভুক্তভোগী সাদ্দাম চোকদার ও বকুল চোকদার বলেন, আমাদের ৯ জনের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় ছিনতাই মামলা হয়। সেই মামলায় আমরা তিনজন হাইকোর্ট থেকে জামিন নিই। তবুও আমাদের থানায় এবং একটি বাড়িতে আটকে ৭২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান। আমাদের বেধড়ক মারধর করেন তারা। হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলেন। ৩০ ঘণ্টা তারা শুধু নির্যাতন করেছেন, খাবার-ওষুধ কিছুই দেননি। নির্যাতনের শিকার ঠান্ডু চোকদার বলেন, ছিনতাই মামলার ঘটনায় ৩১ মে বকুলদের বাড়িতে দুই পক্ষ সালিশ বসে। সেখানে আমিও ছিলাম। দরবার শেষে বাড়ি ফেরার পথে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি (তদন্ত) সরুজ, এসআই ফিরোজ আল মামুনসহ সাত-আটজন আমাকে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ওসির রুমে নিয়ে ভোর পর্যন্ত আমাকে মারধর করে। পরে চোখ খুলে দিয়ে ছোট ভাই সাদ্দাম-বকুলকে ছাড়াতে ৭২ লাখ টাকা দাবি করেন রাসেল। তাদের বাঁচাতে চাচা রশিদ চোকদারের মাধ্যমে পাঁচটি চেকে মোট ৭২ লাখ টাকা দিই ওসি মোস্তাফিজুর রহমানকে।
তবে পদ্মা দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছিনতাই মামলার বাদীপক্ষ তাদের মারধর করেছে। এ বিষয়ে আমার সম্পৃক্ততা নেই। চেকের বিষয়েও আমার জানা নেই। আর নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনিরের মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল হক বলেন, গত ২৩ মে পদ্মা দক্ষিণ থানায় দ্রুত বিচার আইনে একটি মামলা হয়। এই মামলার জেরে পরে কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলো তদন্তে তিন সদস্যের কমিটিও করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পেলে আইগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন