নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনী সহিংসতায় যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার আতংকে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রাম। গ্রেপ্তার এড়াতে গ্রামবাসী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে বুধবার (১৩ মার্চ) পর্যন্ত দুধঘাটা গ্রামে প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। ওই ঘটনায় দুটি মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের পুরুষ সদস্যরা। এদিকে ঘটনার পঞ্চম দিনেও দুধঘাটা গ্রামের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়নি। এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বুধবারও ওই গ্রামে পুলিশের একটি গাড়ি অবস্থান করছিল।
এরইমধ্যে মঙ্গলবার ভোরে পুলিশ বিজয়ী প্রার্থীর দুই কর্মী সমর্থককে গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠিয়েছে। আদালত তাদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামের কাশেম আলী সরকারের ছেলে শহিদুল ইসলাম সরকার ও ছোট কোরবানপুর এলাকার ফরিদ উদ্দিনের ছেলে হযরত আলী।
এদিকে নির্বাচনী সহিংসতায় হৃদয় ভূঁইয়া নামের যুবক নিহত হওয়ার ঘটনায় গত রোববার বিকেলে নিহতের বড় ভাই ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় নির্বাচনে সদ্য বিজয়ী ইউপি সদস্য আব্দুল আজিজ সরকারসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। পাশাপাশি আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত আরও অনেককে। এছাড়াও ফল ঘোষণার পর পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় সোনারগাঁ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফিরোজ আহম্মেদ বাদী হয়ে পৃথক আরেকটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, পিরোজপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে উপনির্বাচনে গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইউপি সদস্য পদে দুধঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মোরগ প্রতীকে আব্দুল আজিজ সরকার ও তালা প্রতীকে কায়সার আহম্মেদ রাজু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোটগ্রহণ শেষে আজিজ সরকার মোরগ প্রতীকে ৯২৯ ভোট ও তালা প্রতীকে কায়সার আহম্মেদ রাজু ৮১১ ভোট পান। এ সময় ফল জানার পর ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে পুনরায় ভোট গণনার অনুরোধ করেন। পুনরায় ভোট গণনা করে রাজুর পক্ষে এক ভোট যুক্ত হয়। এ নিয়ে রাজুর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। রাজু প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে তৃতীয় দফায় ভোট গণনা করতে দাবি করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে রাজু কৌশলে কেন্দ্রের বাইরে চলে যান। বিষয়টি তার কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা লোকজনকে উপজেলায় আসতে বাধা সৃষ্টি করে।
একপর্যায়ে রাজুর সমর্থকরা ভোটে ব্যবহৃত ব্যালটের বস্তা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় গুলিতে কায়সার আহম্মেদ রাজুর সমর্থক দুধঘাটা গ্রামের আমির আলী ভূঁইয়ার ছেলে হৃদয় ভূঁইয়া ও কামাল ভূঁইয়ার ছেলে ওমর ফারুক (২৭) গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়াও ১২ জন আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে হৃদয় ভূঁইয়া মারা যান। এ ঘটনায় পুলিশের ৮ সদস্য আহত হন। পুলিশ সদস্যদের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
বুধবার সকালে সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে যায়, গ্রেপ্তার আতংকে ওই এলাকায় প্রায় পুরুষশূন্য। দুই মামলায় দুই শতাধিক আসামি করে মামলা দেওয়ার কারণে ওই গ্রামের পুরুষরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। পুলিশের দায়ের করা মামলায় আসামি অজ্ঞাত থাকার কারণে যে কেউ গ্রেপ্তার হতে পারে এমন আশঙ্কায় বাড়ি ছাড়া গ্রামের পুরুষ মানুষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই গ্রামের দুজন ব্যক্তি জানান, নির্বাচনে ফল শেষে মিছিল নিয়ে আজিজ সরকারের লোকজন বাড়ি চলে যায়। ফল ঘোষণার প্রায় ১০-১২ মিনিট পর নির্বাচনের কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা ব্যালটের বস্তা নিয়ে উপজেলায় যাওয়ার জন্য রওনা হন। নির্বাচন কেন্দ্র থেকে প্রায় ১০ গজ যাওয়ার পর পরাজিত প্রার্থীর কয়েকজন লোক ওই বস্তাটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। অনেকেই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ সময় হৃদয় ভূঁইয়া মারা যায়। তবে পুলিশ ও নিহতের পরিবার স্পষ্টভাবে ভিন্ন কথা বলছেন।
নিহতের বড় ভাই রিটন ভূঁইয়ার দাবি, নির্বাচনী সহিংসতায় তার ছোট ভাই হৃদয় ভূঁইয়া কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। নির্বাচন শেষে ফল জানতে গিয়ে আজিজ সরকারের সমর্থকদের গুলিতে মারা যায়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি করেন।
নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী আজিজ সরকারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে কথা হয় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা রুনার সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্বামী গত শনিবার বিজয়ী হওয়ায় কর্মী সমর্থক নিয়ে আনন্দ মিছিল করে বাড়ি চলে যান। পরে জানতে পারেন পরাজিত প্রার্থী রাজুর কর্মী সমর্থকরা ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মারা যায়। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার হয়রানি করার জন্য আমাদের কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেন। এ মামলার তদন্ত অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে করার দাবি করছি। সুষ্ঠু তদন্ত হলে গুলির আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।
সোনারগাঁ থানার ওসি এস এম কামরুজ্জামান বলেন, নির্বাচনী সহিংসতার পর থেকেই আসামিরা পলাতক। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
মন্তব্য করুন