লালমনিরহাটের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে রেখা খাতুন। পরিবারের অভাব-অনটনের মধ্যে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল স্থানীয় দিনমজুর কোরবান আলীর সঙ্গে। স্বামীকে নিয়ে বসবাস করতেন লালমনিরহাট শহরের খোঁচবাড়ি এলাকায়। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিন পরেই রেখাকে কুপ্রস্তাব দেয় স্বামীর বড় ভাই। সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ২৪ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে রেখাকে।
দীর্ঘ কারাভোগের পর জেল থেকে বের হয়ে রেখা দেখেন, মা-বাবাসহ পরিবারের ২৫ সদস্য মারা গেছেন। যাদের কোনো খবরই পাননি মেয়েটি। হারিয়ে গেছে রেখে যাওয়া বাড়িঘর। এমনকি স্বামীও আরেক মেয়েকে বিয়ে করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
কারাগার থেকে বের হয়ে এখন তার কাছে পৃথিবীটাই যেন বড় কারাগার হয়ে দেখা দিয়েছে। অথচ তিনি জানেনই না, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী, আর তাকে কেন ২৪ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। হৃদয়বিদারক সিনেমাকেও হার মানানো এমন ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে লালমনিরহাটের রেখা খাতুন নামে এক নারীর জীবনে।
রেখার দাবি, বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর বড় ভাই তাকে কুপ্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি হননি তিনি। এর কয়েকদিন পর ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর পুলিশ হঠাৎ তাকে গ্রেপ্তার করে। কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কী তার অপরাধ—এসব কিছু জানেন না রেখা। পরে জানতে পারেন, কোনো এক ধর্ষণ মামলায় তিনি ধর্ষণে সহযোগিতা করেছেন বলে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অতিদরিদ্র পরিবারের মেয়ে রেখা। তাই মামলা চালানো বা আদালতে খোঁজখবর নেওয়ার লোক হয়নি। কেউ কোনো দিন তার জামিনের আবেদনও করেনি। তার পক্ষে কোনো দিন কোনো আইনজীবীও কথা বলেননি। এভাবে চলতে চলতে ২০০৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় হয়ে যায়। রায়ে ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয় রেখার। একই সঙ্গে ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কিছুদিন হলো সেই ২৪ বছরের কারাদণ্ড শেষ হয়েছে। কিন্তু ১ লাখ টাকা দিতে না পারলে জেল খাটতে হবে আরও এক বছর। এই খবর জানতে পেরে জরিমানার এক লাখ টাকা পরিশোধ করেন লালমনিরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমানের স্ত্রী কবি ও সমাজসেবী ফেরদৌসী বেগম বিউটিসহ আরও কয়েকজন। অবশেষে গত ৯ এপ্রিল কারাগার থেকে মুক্তি মিলেছে রেখার।
কিন্তু কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আটকে গেছেন পৃথিবী নামক কারাগারে। দীর্ঘ ২৪ বছরের মা, বাবাসহ পরিবারের ২৫ সদস্যকে হারিয়ে ফেলেছেন। তারা কেউ আর পৃথিবীতে নেই। তবে পরিবারের ২৫ সদস্যের মৃত্যুর কোনো খবরই জানতেন না রেখা। এখন কী করবেন, কোথায় যাবেন—সেসব প্রশ্নেরও উত্তর নেই রেখার কাছে।
শুধু পরিবারের সদস্য নয়, হারিয়েছেন বসতভিটাও। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে ঘরবাড়ি। আর যে স্বামীর ঘরে সংসার শুরু করে জীবনের এই পরিণতি সেই স্বামীও বেমালুম ভুলে গেছেন রেখাকে। অন্য মেয়েকে বিয়ে করে এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন স্বামী।
মন্তব্য করুন