সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রের নাম বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আলোচিত চাঁদাবাজ রকিব আলী ও তার বাহিনীর সদস্যরা। লালদীঘিপাড়ের মাঠে গড়ে উঠেছে রকিব বাহিনীর ত্রাসের রাজত্ব। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলার সাহস পায়নি। এই চক্রে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান রুমন নামের এ চাঁদাবাজ। ফলে এই চক্রের সদস্যরা বেপরোয়া। এই চক্রটি মানুষকে মরা গরু পর্যন্ত খাওয়াচ্ছে। কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না।
সম্প্রতি লালদীঘির পারের মাঠে জবাই করার জন্য একটি গরু বেঁধে রাখেন রকিব। পরে ডিপ টিউবওয়েলের বিদ্যুতের তারে লেগে গরুটির মৃত্যু হয়। এরপর রকিবকে খবর দেওয়া হলে সে এসে গরুটি জীবিত বলে কেটে মাংসগুলো বিক্রি করে দেয়। এ বিষয় নিয়ে লালদীঘির পারের মাঠে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে রকিব আলীর দাবি তিনি জীবিত গরু জবাই করে বিক্রি করেছেন। গরুটি মরার আগেই জবাই করা হয়। কিন্তু ডিপ টিউবওয়েলের ঠিকাদারের কাছ ৮০ হাজার টাকা গরু বাবদ জরিমানা আদায় করেন। ঠিকাদার বাধ্য হয়ে রকিব আলীকে ৮০ হাজার টাকা প্রদান করেন।
হকার ব্যবসায়ীরা জানান, সিলেট সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হয় রকিব। এরপর হকার পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন মেয়র। সেই সুবাদে হকার ব্যবসায়ীরা একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির সভাপতি দেওয়া হয় রকিব আলীকে। তারই নেতৃত্বে শুরু হয় হকার পুনর্বাসনের কার্যক্রম। সেই কার্যক্রমকে পুঁজি করে রকিব তার আশীর্বাদপুষ্টদের নিয়ে মাঠে দোকান কোঠা দখল করা শুরু করে। একেক জনের নামে ৫-৬টি দোকান বরাদ্দ করেন। শুরু করেন মাছ ও সবজি ব্যবসায়ীদের কাছে দোকান বিক্রি। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদও করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ কাজে আসেনি। রকিব আলী মেয়রের নাম ভাঙিয়ে এবং মাটি ভরাটের নামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী জানান, টাকা তোলার পারমিশন কাউকে দেওয়া হয়নি। ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করে মাটি ভরাট থেকে শুরু করে সবই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। কেউ টাকা তোলার কথা না। প্রমাণ থাকলে আপনারা তার বিরুদ্ধে লেখুন।
রকিব আলীর এসব কাজে জড়িত রয়েছেন সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। যার ফলে সে কোনো কিছু তোয়াক্কা করছে না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ যাদের কখনো ফুটপাতে ব্যবসা করতে দেখা যায়নি তাদের কাছে টাকার বিনিময় দোকান বিক্রি করা হয়েছে। এরমধ্যে একজন ব্যাংকে চাকরি করেন তাকে দেওয়া হয়েছে চারটি দোকান। কিন্তু প্রকৃত হকারেরা একটি দোকানও পাচ্ছে না। সবজি ও মাছওয়ালাদের মাঠে ভিতরে বসানোর কথা থাকলেও রকিব বাণিজ্যের জন্য এদের সামনে বসিয়েছে। এজন্যই বিপাকে পড়েছেন কাপড়ের ব্যবসয়ীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হকারমুক্ত হয়েছে সিলেটের ফুটপাত। হকারদের ঠিকানা হয়েছে লালদীঘির পারের মাঠে। সেখানে গড়ে দেওয়া হয় প্রায় ৭০০ দোকান। শুরু থেকেই হকাররা লালদীঘির পারের মাঠে যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তবে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতার কারণে একসময় নিজেদের সেখানে মানিয়ে নেন তারা। লালদিঘীর পারেই গড়ে তুলেন নিজেদের নতুন ভুবন। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন তারা। তবে তাদের সে স্বপ্নে হানা দিয়েছেন তাদেরই এক নেতা। সিলেট মহানগর হকার ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি রকিব আলীই তাদের সে দুঃস্বপ্নের নাম। লালদিঘীরপাড়ে এখন কেবল তারই রাজত্ব। সাধারণ হকাররা কিছু বলতেও পারেন না, সইতেও পারেন না।
হকার পুনর্বাসনের পর প্রশংসায় ভাসছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামা চৌধুরী। হকারদের ব্যবসার জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছিল সিসিক। তবুও শান্তিতে নেই হকার ব্যবসায়ীরা। সিসিক থেকে হকারদের কাছ থেকে কোনো জামানত বা ভাড়া নেওয়ার কথা না থাকলেও দোকান দেওয়ার কথা বলে হকারপ্রতি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে নিচ্ছেন রকিব আলী। কিন্তু টাকা নেওয়ার পর দোকান ‘বিক্রি’ করছেন অন্য জনের কাছে। কেউ কিছু বলতে পারছেন না। রকিব আলী নিজেকে পরিচয় দেন মেয়রের ‘আপন’ মানুষ হিসেবে। তার কথামতো না চললে ভয়-ভীতিও দেখান।
সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, লালদীঘিরপাড়ে ফুটপাতের মত ব্যবসা হয় না। তারপরও মেয়রের কথা শুনে ও নগরের সৌন্দর্যের কথা মাথায় রেখে তারা এখানে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখানে তাদের জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে বাধা হয়ে টিকতে দাঁড়িয়েছেন রকিব আলী। না পেরে কেউ কেউ আবার চলে এসেছেন রাস্তায়।
এমনই এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ফরহাদ বললেন, আমরা হকার মার্কেটে দোকানের জন্য জন্য টাকা দিয়েছি। আমার নাম বায়ান্ন নম্বরে উঠেছে। আমি ভিতরে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর গিয়ে দেখি দোকান নাই। আমার জায়গা আরেক জনকে দিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা পেটের দায়ে আবার রাস্তায় বের হয়েছি।
আরেক ব্যবসায়ী জানান, আমি ত্রিশ নম্বরে জায়গা পেয়েছিলাম। ঘর তোল জন্য টাকাও দিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমার জায়গা অন্যজনকে দিয়ে দিয়েছে। এজন্য এখন আমি রাস্তায় দোকান দিচ্ছি। সিলেট মহানগর হকার ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সিনিয়র সহ সভাপতি আতাউর রহমান বলেন, আমরা মাঠে আসার পর আমাদের কারো কোনো পুঁজি ছিল না। আমরা সভাপতি (রকিব আলী) কে মেয়রের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি কিন্তু তিনি নানান বাহানা করে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মেয়র পর্যন্ত আমাদের কাউকে পোঁছাতে দেয়নি। আমাদের মিটিংগুলোতে আমরা জোড়ালো দাবি করেছি আমরা আমাদের সুখ- দুঃখের কথা মেয়রের কাছে তুলে ধরবে। কিন্তু তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি।
সিলেট মহানগর হকার ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খোকন ইসলাম বলেন, সিলেট জেলা পরিষদে মেয়রের সঙ্গে আমরা একবার মিটিং করেছিলাম। তারপর আর আমরা মেয়রের দেখা পাইনি। আমরা নগরীর জনগণের স্বার্থে আমরা ফুটপাত ছেড়ে লালদীঘিরপার মার্কেটে গিয়েছিলাম। আমরা ও চাই রাষ্ট্রীয় যানজন না থাকুক। ফুটপাত সুন্দর থাকুক এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যান সভাপতি। আমি যখন দেখলাম কাজে ও কথায় মিল নাই তখন আমি আর একাত্মতা পোষণ না করে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ করি। তিনি আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে শুরু করেন। এখানে যতগুলো কাপড়ের দোকান আছে তারা তাদের নিজ দায়িত্বে নিজেদের টাকা ব্যয় করে দোকান তৈরি করেছেন। এই দোকান কোঠা ভাড়ার বিষয়ে আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জানি না। কিছু বিশেষ ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে দোকান কোঠা।
দোকান কোঠার জন্য টাকা নিয়ে অন্য জনকে দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সভাপতি রকিব আলী বলেন, এগুলো সব মিথ্যা কথা। এখানে এখনো ছয় থেকে সাতশ হকার আছে। টাকা নিয়ে টিনশেড করে ঘর বানাচ্ছি, মাটি ভরাট করে দিচ্ছি, লাইটিং করছি। প্রত্যেকটি দোকান তৈরি করতে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। তারা সেই টাকাটা আমাকে কিছু কিছু করে টাকা দিচ্ছে। যারা অভিযোগ করছেন তারা মূলত বাইরের ব্যবসায়ী। এরকম হবে তারা চিন্তা করেনি। কিছু নেতাকর্মী আছে ব্যবসায়ীদের বুদ্ধি দিচ্ছেন বাইরে গেলে আবার ব্যবসা হবে। রকিব আলী আমাদের ঠকাচ্ছে, বদনাম করছে।
সভাপতি রকিব আলীর টাকা নেওয়ার বিষয়ে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, টাকা তোলার পারমিশন কাউকে দেওয়া হয়নি। ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করে মাটি ভরাট থেকে শুরু করে সবই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। কেউ টাকা তোলার কথা না। আমরা লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। রকিবকে জিজ্ঞেস করেছি, সে টাকার নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। আমরা প্রতি হকারের দোকানদারদের ফ্রিতে ইলেকট্রিক মিটার দিচ্ছি। আমার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তদন্তের জন্য সিআরওকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন