

মানবপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আইনগত কাঠামো গড়ে তুলতে আইন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভুক্তভোগীকেন্দ্রিক, ট্রমা সচেতন এবং লিঙ্গ সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারের বক্তারা।
তারা বলেন, মৌলিক আইনগত জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন ভবিষ্যৎ আইনজীবীদের জন্য অপরিহার্য, যা ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ ও আইনের শাসন জোরদারে সহায়ক হবে।
“এডুকেটিং ফর জাস্টিস: এমপাওয়ারিং ল’ গ্র্যাজুয়েটস টু ফাইট হিউম্যান ট্রাফিকিং (Educating for Justice: Empowering Law Graduates to Fight Human Trafficking)” শীর্ষক সেমিনারটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের এ কে খান অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়।
এতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং আইন পেশাজীবীরা অংশ নেন। আলোচনায় মানবপাচার বিরোধী আইন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ, তদন্ত ও প্রমাণ সংগ্রহ, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যমে শোষণের মতো নতুন প্রবণতার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) যৌথভাবে সেমিনারটি আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কুইজ প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আইওএমের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে রেফারেন্স বই হস্তান্তর করা হয়।
মানবপাচার প্রতিরোধে যুবসমাজ ও একাডেমিয়ার ভূমিকা স্বীকার করে আইওএম তার কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় পর্যায়ের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা “সেফগার্ডিং লাইভস – হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রিভেনশন (Safeguarding Lives – Human Trafficking Prevention)”।
সেমিনারের শেষে আইন অনুষদের সেমিনার হলে আইওএমের সহায়তায় এবং কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কোইকা)-এর অর্থায়নে আইটি সরঞ্জামসহ একটি বুক কর্নার উদ্বোধন করা হয়, যা মানবপাচার বিরোধী বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি একাডেমিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে সহায়ক হবে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম. জাফর উল্লাহ তালুকদার এবং আইওএমের হেড অব প্রোটেকশন পূজা ভাল্লা একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ও বিচার খাতের অংশীজনদের মধ্যে সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
মূল প্রবন্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এ.বি.এম. আবু নোমান মানবপাচার বিষয়ক আইনকে স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন, যাতে শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তবমুখী দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (রাজনৈতিক অনুবিভাগ-৩) মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ সেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তদন্ত, প্রমাণ সংগ্রহ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় সংক্রান্ত বাস্তব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়।
সেমিনারের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক অনুবিভাগ-১) মু. জসীম উদ্দিন খান। তিনি ভবিষ্যৎ আইনজীবীদের নৈতিক দায়িত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, শুধু আইন ও বিধি সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই চলবে না। একজন পেশাজীবীর জন্য বিশ্লেষণী ক্ষমতা, কারিগরি দক্ষতা এবং নৈতিক মানদণ্ড অপরিহার্য। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাসঙ্গিক তথ্য, প্রমাণ এবং বাস্তব প্রেক্ষাপটের সুপরিকল্পিত মূল্যায়ন জরুরি।
দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত একটি বিস্তৃত সেমিনার সিরিজের অংশ চবি’র এই সেমিনারটি। এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিচার খাতের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সম্পৃক্ততা জোরদার করা এবং আইওএম কর্তৃক উন্নয়নকৃত মানবপাচার আইন মডিউলকে স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একাডেমিক প্রস্তুতি সৃষ্টি করা।
এসব উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার, ফৌজদারি বিচার এবং মানবপাচার প্রতিরোধে পেশাগত পথ বেছে নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত একটি আরও সক্ষম ও ভুক্তভোগীকেন্দ্রিক জাতীয় বিচার ব্যবস্থায় অবদান রাখবে।
মন্তব্য করুন