রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে প্রস্রাবের রং হলুদ হয়। চোখ, ত্বক ও মুখের ভেতর হলদেটে ভাব ফুটে ওঠে। এমন পরিস্থিতিকে সাধারণত জন্ডিস বলা হয়ে থাকে।
জন্ডিসের পাশাপাশি অরুচি, ক্ষুধামান্দ্য, বমি বমি ভাব, জ্বর জ্বর ভাব বা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, মৃদু বা তীব্র পেটব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশেষ করে একজন লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। যাতে করে চিকিৎসক রোগীর শারীরিক লক্ষণ, রক্তনালির পরীক্ষার মাধ্যমে জন্ডিসের তীব্রতা ও কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র দিতে পারেন।
যকৃৎ বা পিত্তনালির কোনো সমস্যা দেখা দিলেই সাধারণত জন্ডিস হয়ে থাকে। জন্ডিস আসলে কোনো রোগ নয়, এটি রোগের লক্ষণ মাত্র। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ৩ মিলিগ্রাম বা ডেসিলিটারের চেয়েও বেশি হয় জন্ডিস হলে। ফলে ত্বক, স্ক্লের বা চোখের সাদা অংশ ও অন্যন্য মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে নানা প্রদাহ বা লক্ষণকে জন্ডিস বলা হয়।
হেপাটাইটিস বা যকৃতের প্রদাহ, পিত্তনালির ব্লক বা পিত্তরসের পথে বাধা ও হিমোলাইসিস অথবা সময়ের আগেই রক্তের লোহিত রক্তকণিকার ভেঙে যাওয়া। এই তিনটি কারণে মূলত জন্ডিস দেখা দেয়।
নানা রকম ভাইরাস হেপাটাইটিসের অন্যতম কারণ। খাদ্য ও পানির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায় হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’। আর ‘বি‘, ‘সি’ও ‘ডি’দূষিত রক্ত, সিরিঞ্জ এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়।
জন্ডিসের প্রধান কারণ লিভারের রোগ। আমরা যা কিছুই খাই, তা প্রক্রিয়াজাত হয় লিভারে। নানা কারণে রোগাক্রান্ত হতে পারে লিভার। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাসগুলো লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যাকে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলা হয়। আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বেই জন্ডিসের প্রধান কারণ এই হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলো। তবে উন্নত দেশগুলোতে অতিরিক্ত মদ্যপান জন্ডিসের একটি অন্যতম কারণ।
জন্ডিসের সাধারণ উপসর্গ হলো চোখ ও প্রস্রাবের রং হলুদ হওয়া। হেপাটাইটিসের পাশাপাশি ক্ষুধামান্দ্য, অরুচি, অবসাদ, বমি ভাব, জ্বর জ্বর অনুভূতি কিংবা কাঁপানি দিয়ে জ্বর আসা, মৃদু বা তীব্র পেটব্যথাও হতে পারে। এমনকি চুলকানিও হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ও লিভারের এনজাইমগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে জন্ডিস বোঝা যায়। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে লিভার প্রদাহ, পিত্তনালির প্রদাহ, পিত্তনালির ব্লক, গিলবার্ট’স সিনড্রোম, ডুবিন-জনসন সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। আর জন্ডিসের কারণ জানতে ভাইরাস পরীক্ষা করার পরামর্শ চিকিৎসদের।
গ্রামগঞ্জে মেটে জন্ডিস নামে একটা শব্দ চালু আছে। কোনো কারণে খাওয়ায় অরুচি দেখা দিলেই জন্ডিস হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। নানা ধরনের ঝাড়ফুঁক, তাবিজ–কবজ নেওয়া শুরু করেন অনেকে। আসলে মেটে জন্ডিস বলে কিছু নেই বলছেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে ঠিক কী কারণে জন্ডিস হলো তার ওপর। তবে জন্ডিস থেকে বেঁচে থাকতে আমাদের কিছু করণীয় আছে। জন্ডিস প্রতিরোধে সে সম্পর্ক জেনে নেওয়া দরকার।
* হেপাটাইটিস-‘এ’ও ‘ই’খাদ্য ও পানির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়। আর ‘বি ‘, ‘সি’ও ‘ডি’ দূষিত রক্ত, সিরিঞ্জ এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। এ জন্য সব সময় বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে হবে। শরীরে রক্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং করে নিতে হবে। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের ব্যবহারও জরুরি।
নেশাদ্রব্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
কল কারখানার রাসায়নিক পদার্থ থেকে দূরে থাকুন।
ব্যবহারকৃত ইনজেকশন কিংবা নাক-কান ফোঁড়ানোর সুই ব্যবহার করবেন না। যারা সেলুনে সেভ করেন, তাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন আগে ব্যবহার করা ব্লেড বা ক্ষুর আবারও ব্যবহার করা না হয়।
নিরাপদ যৌন মিলন করুন।
হেপাটাইটিস‘এ’ও ‘বি’হওয়ার আশঙ্কা মুক্ত থাকতে হেপাটাইটিস ‘এ’ও ‘বি’-এর ভ্যাকসিন নিন।
পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিন। কেননা বিশ্রাম না নিলে যকৃতের ওপর চাপ বাড়বে, বিলিরুবিন আরও বাড়বে। প্রয়োজনে বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি হলে শোয়া অবস্থায় থাকুন।
স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করুন। খাবার নিয়ে অতিরিক্ত বিধিনিষেধের দরকার নেই। পুষ্টিকর, রুচিকর, স্বাস্থ্যকর যে কোনো খাবার গ্রহণ করতে পারবেন।
পানি পান স্বাভাবিক মাত্রায় করুন। অতিরিক্ত পানি পান, আখের রস, নানা রকমের জুস জন্ডিসে উপকার আনে এমন ধারণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
প্রতিদিন গোসল করুন। পরিচ্ছন্ন থাকুন। জন্ডিস হলে যকৃতের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ সময় যে কোনো ধরনের ওষুধ গ্রহণ না করাই উত্তম। পেটব্যথা বা বমির জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে পারেন। যারা আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খান, তারা চালিয়ে যাবেন। ডায়াবেটিসের ওষুধ বন্ধ করে এ সময় ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
কোনো রকম কবিরাজি, গাছের লতাপাতা, রস এগুলো খাওয়া যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। যে কোনো জিনিসই শরীরে প্রবেশ করার পর যকৃতে বিপাক হয়। এসব জিনিস আরও বাড়িয়ে দিতে পারে যকৃতের প্রদাহ।
লিভার টনিক, সালসা সিরাপ, পড়া পানি, জন্ডিস সারানোর তরল হিসেবে যা বিক্রি হয়, তার কোনোটাই কাজে আসে না। বরং তা উল্টো লিভারের ক্ষতি করতে পারে। বেশির ভাগ জন্ডিস বিশ্রামেই আরোগ্য হয়। তাই এসব অপচিকিৎসা থেকে বিরত থাকতে হবে।
অনেকেই মনে করেন জন্ডিস হলে হলুদ বা মসলা খাওয়া যাবে না। এমন ধারণা ঠিক নয়। খাবারে রুচি বাড়াতে সাধারণত যতটুকু তেল-মসলা ব্যবহার করার, তা করবেন। তবে বেশি ভারি বা ভাজাপোড়া খাবার না খাওয়ায় ভালো।
অনেকে জন্ডিস হলে সব খাবার বাদ দিয়ে কেবল তরল, আখের রস, চিনির শরবত ইত্যাদি খেয়ে থাকেন। মাছ মাংস ও আমিষ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এতে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি থাকে। শুধু শর্করা খেলে হবে না, সুষম খাবারও পর্যাপ্ত গ্রহণ করতে হবে।
জন্ডিস হলে দিনে কয়েক বার গোসল করলে শরীরের হলুদ বেরিয়ে যাবে বলেও যে উদ্ভট ধারণা প্রচলিত আছে এর কোনো ভিত্তি নেই। উল্টো অধিক গোসলের ফলে ঠান্ডা লাগার ঝুঁকি বাড়ে।
কখন হাসপাতালে যাওয়া উচিত
পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবারেই অধিকাংশ জন্ডিসের রোগী সেরে যায়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে কম বেশি সময় লাগতে পারে। জটিলতা দেখা দিলে কখনো হাসপাতালে ভর্তির দরকার হতে পারে। যদি রোগীর বিলিরুবিনের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়, রোগী মুখে কিছুই খেতে না পারেন বা অতিরিক্ত বমি হতে থাকে এমন অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া রোগীর আনুষঙ্গিক অন্যান্য সমস্যা যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগ ইত্যাদি থাকলে, যদি জন্ডিস আক্রান্ত রোগী গর্ভবতী থাকেন বা রোগী অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করেন তখন যথাসম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
মন্তব্য করুন