ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাত নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়টি জানিয়েছে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব।
বৃহস্পতিবার (০৮ মে) এক প্রতিবেদনে ডিসমিসল্যাব জানায়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এসব প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ছে বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য, যা শুধু সাধারণ জনগণকে নয়, গণমাধ্যমকেও বিভ্রান্ত করছে।
এতে বলা হয়, বিশেষত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়া কিংবা সীমান্তে গোলাগুলির ছবি ও ভিডিও ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে। তবে এই সব তথ্য ও চিত্রের অনেকগুলোর উৎস পুরোনো বা ভিন্ন ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেগুলোকে বর্তমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা জনমনে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ভুয়া দাবি এবং বিভ্রান্তিকর ছবি-ভিডিও যাচাই করেছে ডিসমিসল্যাব।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে- ‘ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান পাকিস্তান ভূপাতিত করেছে এবং কয়েকজন ভারতীয় পাইলটকে আটক করা হয়েছে।’ ভিডিওটিতে বিস্ফোরণের পর একটি বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে।
তবে ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলোর প্রাথমিক বিশ্লেষণে জানা গেছে, ভিডিওটি মূলত পুরোনো এবং ভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ধারণকৃত। এটি বর্তমান ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। এই ধরনের ভুয়া ভিডিও ও অতিরঞ্জিত দাবি সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আরেকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে একটি বিমানকে ভূপাতিত করার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি দাবি করা হচ্ছে, এটি ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দৃশ্য।
তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে জানা গেছে, এটি ২৪ ঘণ্টা আগে পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার কোনো ভিডিও নয়। ভিডিওটি আসলে অন্তত ৯ দিন আগে ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিল। এর সঙ্গে বর্তমান ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই।
ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার দাবিকে ঘিরে একটি ছবি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যবহার হতে দেখা গেছে, যেখানে একটি বিধ্বস্ত বিমানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে কিছু গণমাধ্যম এই ছবি ফটোকার্ডে ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে তা সরিয়ে নেয়।
তথ্য যাচাইয়ে (ফ্যাক্টচেক) দেখা গেছে, ছবিটি সাম্প্রতিক কোনো সংঘর্ষের নয়। এটি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের রাজস্থানে ঘটানো একটি দুর্ঘটনার দৃশ্য। সেসময় প্রশিক্ষণ মিশনের সময় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল।
ফেসবুকে আরেকটি ভিডিও পোস্ট হতে দেখা যাচ্ছে। এতে ক্যাপশনে ‘আল্লাহু আকবার, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এবং ‘আলহামদুলিল্লাহ’ লেখা হয়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছেন।
ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি একটি ভিডিও গেমের দৃশ্য। চলতি বছরের ৩১ মার্চ ইউটিউবে আপলোড হওয়া এই ভিডিওটির শিরোনাম ছিল ‘অন টার্গেট! গ্রোজনিতে মার্কিন জেভেলিন রাশিয়ান হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে! আরমা৩’। আরমা৩ হলো একটি ভিডিও গেম। ভিডিওর বিবরণেও এটিকে গেমের দৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এমন দাবিযুক্ত ফেসবুক পোস্টে ভিডিও যুক্ত করা হচ্ছে, যেখানে একটি এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটির ডান দিকে ওপরের প্রান্তে ‘ইন্ডিয়া’ লেখাটি দেখা যায়।
একটি বিস্ফোরণের একটি দৃশ্য দেখা যায়, যার ভিত্তিতে দাবি করা হচ্ছে- এটি ভারত বা পাকিস্তানে সংঘটিত হামলার চিত্র। তবে যাচাইয়ে জানা গেছে, ভিডিওটি ভারত বা পাকিস্তানের নয়। এটি অন্তত সাত মাস পুরোনো। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা তাদের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে শেয়ার করেছিল। ভিডিওটিকে ‘উত্তর তেল আবিবের হারজেলিয়ায় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দৃশ্য’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। এই ভিডিওকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালানো হচ্ছে।
দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখা যায়, একটি এলাকায় সেনা মহড়া চলছে, যেখানে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে। ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হচ্ছে, ‘আবারও পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে ভারত’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভিডিওটি পুরোনো কোনো সামরিক মহড়ার অংশ এবং এর সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই।
এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ভিডিও ও ভুয়া দাবির ফলে জনমনে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘাত সংবেদনশীল অঞ্চলে এমন গুজব ছড়ালে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই তথ্য যাচাই ছাড়া কোনো ভিডিও বা সংবাদ শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।
পাকিস্তানে ভারতের হামলার দাবি ঘিরে আরও একটি বিভ্রান্তিকর ভিডিও ছড়াচ্ছে। ফেসবুকে সম্প্রতি ছড়ানো একটি ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে- ভারত পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ভিডিওতে একটি এলাকায় বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখা যায় এবং হামলার পর কিছু মানুষকে তাবুর মতো স্থাপনা থেকে দৌড়ে পালাতে দেখা যায়।
তবে ডিসমিসল্যাবের তথ্য যাচাইয়ে উঠে এসেছে, এই ভিডিওটিরও বর্তমান ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ভিডিওটি প্রায় পাঁচ বছর পুরোনো। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি ডিফেন্স দিল্লি রিভিউ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে এটি পোস্ট করা হয়েছিল। ভিডিওর শিরোনামে বলা হয়, ‘দেবলালি রেঞ্জে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১২২ মিমি ‘আপগ্রেডেড’ গ্র্যাড মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারের গুলিবর্ষণ।’ এটি মূলত একটি সামরিক মহড়ার দৃশ্য, কোনো বাস্তব যুদ্ধ বা হামলার নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাকিস্তানে ভারতের হামলা দাবি করে ছড়ানো একটি ভিডিও ঘিরে ব্যাপক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ভিডিওতে একটি বিস্ফোরণের দৃশ্য এবং মানুষকে আহত অবস্থায় দৌড়াতে দেখা যায়। অনেকে এটিকে সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
তবে ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, ভিডিওটি মূলত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বিমান হামলার দৃশ্য। এটি ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর আলজাজিরা প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনের অংশ, যার শিরোনাম ছিল : ‘গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের খবর পাওয়া যাচ্ছে’। প্রতিবেদনের ৫ মিনিট ৭ সেকেন্ড থেকে ছড়ানো ভিডিওর দৃশ্যের সঙ্গে হুবহু মিল পাওয়া যায়।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে, ‘ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং ভারতীয় পাইলটকে আটক করে ক্ষুব্ধ জনতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে।’ ভিডিওতে একটি আগুনে জ্বলতে থাকা বিধ্বস্ত বিমান এবং কিছু মানুষকে আগুন নেভাতে চেষ্টা করতে দেখা যায়।
তবে ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের যাচাই অনুযায়ী, এই ভিডিওটি বর্তমান ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতির সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, এটি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের রাজস্থানে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার ভিডিও, যেখানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়েছিল।
তবে যাচাইয়ে দেখা গেছে, এই ভিডিওটি দুইটি আলাদা ঘটনার সংমিশ্রণ। প্রথম অংশটি ২০২৪ সালের ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানের একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দৃশ্য, যা পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে।
ভিডিওটির ১৪ সেকেন্ড থেকে শুরু হওয়া অংশটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ঘটনা। সেটি হচ্ছে ২০২৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, ভারতের মধ্যপ্রদেশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। এই ভিডিওটিও সে সময় বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
অর্থাৎ, দুটি আলাদা ঘটনার ভিডিওকে একত্র করে বর্তমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে এবং অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা অনুরোধ করেছেন, এমন ভিডিও শেয়ার করার আগে সত্যতা যাচাই করা জরুরি।
মন্তব্য করুন