ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল লেখক ও অধিকারকর্মী সাবরিনা সুলতানার বই ‘শেকলবন্দি স্বাধীনতা’-এর প্রকাশনা উৎসব। শনিবার (৩১ মে) ইউপিএল ও কৃষ্টি ট্রাস্টের যৌথ আয়োজনে এই অনুষ্ঠানটি পরিণত হয় প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার, সামাজিক বৈষম্য এবং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা নিয়ে এক উন্মুক্ত বিতর্ক ও প্রতিবাদের মঞ্চে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ, অর্থাৎ আড়াই কোটির বেশি প্রতিবন্ধী মানুষকে সমাজ আজও অন্ধকারে লুকিয়ে রেখেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো চাকরি, কর্মসংস্থান, শিক্ষার অধিকার বা আত্মমর্যাদার জায়গায় প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি থেকে বঞ্চিত।
‘শেকলবন্দি স্বাধীনতা’র লেখক সাবরিনা সুলতানা বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে প্রতিবন্ধী মানুষের অবস্থার কোনো বাস্তব পরিবর্তন হয়নি। আমাদের দেশে এখনো অধিকারের বদলে কল্যাণমূলক মানসিকতা কাজ করে। প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়ন না হওয়ার দায় শুধু রাষ্ট্রের নয়, যারা এই নিয়ে কাজ করেন, তাদের অনেকেও দায় এড়াতে পারেন না।
তিনি আরও বলেন, এই পৃথিবীতে কিছুই আমরা বিনা দাবিতে পাইনি। প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্যও তাই সংগ্রাম জরুরি। আমরা শুধু শুনি, আমাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। আমাদের যেন স্বাভাবিক জীবনেরও অধিকার নেই।
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুবা বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আমাদের আশা জাগালেও বাস্তবে প্রতিবন্ধী মানুষরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। সরকার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ– কেউই তাদের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা নেয় না।
অধ্যাপক সামিনা লুৎফা প্রতিবন্ধিতা নিয়ে মেডিকেল ও সমাজবিজ্ঞান মডেলের পার্থক্য তুলে ধরে বলেন, সমাজে স্টিগমা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিবন্ধী মানুষদের পথের সবচেয়ে বড় বাধা। সহানুভূতি, সমর্থন ও সহমর্মিতা ছাড়া কোনো সিস্টেমই তাদের জন্য কাজ করে না।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আমাদের রাষ্ট্র এখনো প্রতিবন্ধিতাকে কল্যাণের বিষয় হিসেবে দেখে, অধিকার হিসেবে নয়। সাবরিনা তার লেখায় এই কাঠামোগত সংকটের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত অনেক সময় ইন্সেন্সিটিভ শব্দচয়ন ব্যবহার করে, যা প্রতিবন্ধকতাকে আরও লুকিয়ে রাখে।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় প্রতিবন্ধী মানুষের মঞ্চে ওঠার ব্যবস্থা না থাকা নিজেই এক রাজনৈতিক বার্তা। এ দেশের নীতিনির্ধারকরা ধরেই নেন, প্রতিবন্ধীরা এসব জায়গায় থাকবে না।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারের বিদেশ সফর বা ভর্তুকির জন্য সবসময় টাকা থাকে, কিন্তু জনগণের প্রয়োজনের জন্য নয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা আরও প্রকট। আমরা যদি সত্যিই প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই, তবে রাষ্ট্রের কাঠামো বদলাতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু ব্যক্তিগত সহানুভূতি নয়, রাষ্ট্রীয় স্তরে বৈপ্লবিক মনোভাব ও নীতিগত পরিবর্তন জরুরি। এই বইটি সেই পরিবর্তনের সম্ভাবনার ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দীন বলেন, বাংলাদেশে কোনো পরিকল্পনা বা কাঠামো তৈরি হয় না প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা বিবেচনায় রেখে। এই বই সে অন্ধকারে আলোর রেখা হতে পারে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মীর মোশাররফ হোসাইন বলেন, ‘শেকলবন্দি স্বাধীনতা’ শুধু একটি বই নয়, এটি একটি আন্দোলনের ডাক। এই বই রাষ্ট্র ও সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কাদের কথা আমরা শুনিনি, দেখতে চাইনি, অন্তর্ভুক্ত করিনি।
বইটি প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনের বাস্তবতা, লড়াই এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার চিত্র তুলে ধরে। বক্তারা বলেন, শেকলবন্দি স্বাধীনতা অনিবার্য নয়, একে ভাঙা সম্ভব এবং আমাদেরই তা করতে হবে।
মন্তব্য করুন