পুরান ঢাকার নারিন্দার বুকজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়ারি খ্রিষ্টান সেমেট্রি, যেটি ঢাকার বহুবর্ণ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
ঐতিহ্য সংরক্ষণে শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে এই স্থাপনায় শতবর্ষ প্রাচীন কলম্বো সাহেব সমাধি ও মুরিশ গেটওয়ে পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার সারা ক্যাথরিন কুক, ওয়ারি খ্রিষ্টান সেমেট্রি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ফাদার আলবার্ট রোজারিও, সেমেট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান আর্চবিশপ বিজয় এন. ডিক্রুজসহ আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অতিথিরা এই পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এ সময় এই সেমেট্রিই যেন হয়ে উঠেছিল ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক মিলনস্থল। আর এই নির্মাণ কাজ আমাদের নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল যে, অতীতের সৌধ শুধু পাথর আর ইট নয়- এগুলোই একেকটি সভ্যতার আত্মকথা।
ওয়ারি খ্রিষ্টান সেমেট্রি বোর্ডের উদ্যোগে এবং ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সেমেট্রিজ ইন সাউথ এশিয়া (বিএসিএসএ) ও কমনওয়েলথ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন (সিএইচএফ) এর সহযোগিতায় এই পুরো স্থাপনা পুনর্নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্ন হবে। জানা গেছে, মুরিশ গেটওয়ে এবং কলম্বো সাহেব সমাধি পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে এই কাজের সূচনা হলেও এটি কেবল প্রথম অধ্যায়। দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার কাজও শিগগিরই শুরু হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্য রক্ষার এই প্রয়াস কোনো সাধারণ প্রকল্প নয়; এটি সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার প্রতীক। আমরা শুধু অতীতের নিদর্শন মেরামত করছি না, আমরা আসলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত করছি। প্রতিটি পুনর্নির্মাণই আমাদের জন্য ইতিহাস এবং আগামী দিনের মধ্যে এক নতুন সেতুবন্ধন।
ব্রিটিশ হাই কমিশনার সারা ক্যাথরিন কুক বলেন, এই পুনর্নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আরও গভীর করছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা কেবল অতীতকে সংরক্ষণ করা নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এক অমূল্য উপহার।
কনজারভেশন আর্কিটেক্ট প্রফেসর ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ, যার হাতে প্রকল্পের প্রথম ধাপের পুনর্নির্মাণ বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, এই সমাধি ও গেটওয়ে নিছক স্থাপত্য নয়, এগুলো আসলে সময়ের সাক্ষী। প্রতিটি খোদাই, প্রতিটি ইটে লুকিয়ে আছে গল্প। আমাদের কাজ ছিল ধ্বংসস্তূপকে নতুন করে সাজানো নয়, বরং অতীতের সেই নিসর্গকে অক্ষত রেখে পুনরুজ্জীবিত করা। এটি ইতিহাসের সঙ্গে আজকের ঢাকাকে নতুন করে যুক্ত করেছে।
ফাদার আলবার্ট রোজারিও বলেন, আমরা চাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখানে এসে শুধু পুরোনো সমাধি বা ফটক দেখবে না; তারা অনুভব করবে ইতিহাসের গভীরতা, শহরের ঐতিহ্যের আত্মা।
সভাপতির বক্তব্যে আর্চবিশপ বিজয় এন. ডি’ক্রুজ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, নারিন্দার এই সেমেট্রি শুধু ইতিহাসের স্থান নয়, এটি আমাদের পরিচয়ের অংশ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অবৈধ দখল, দোকান বসানো, মাদকসেবন ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডে এই পবিত্র স্থানটি ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে। প্রশাসনকে জানিয়েও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাই আজকের এ মঞ্চ থেকে আমি সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার সরাসরি সহযোগিতা কামনা করছি।
অতিথি, কূটনীতিক ও স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে ঐতিহ্যের এই উজ্জ্বল আয়োজন চা-আড্ডার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। রাতে বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএ) পাবলিক রিলেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্টের স্ট্র্যাটেজিস্ট অপু প্লাসিড প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
মন্তব্য করুন