ভাষা আন্দোলনে (মরণোত্তর) একুশে পদক-২০২৪ পাচ্ছেন মৌ. আশরাফুদ্দীন আহমদ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
মৌ. আশরাফুদ্দীন ১৯২২ সালের ১ জুন বৃহত্তর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের চরপুম্বাইল গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ৬ মাস পর মাতৃহীন হয়ে যান তিনি। খালার কাছে বড় হন মৌ. আশরাফুদ্দীন। মামা বাড়িতেই কাটে তার শৈশব।
মৌ. আশরাফুদ্দীন দিলালপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে ভালো ফলাফল করে বৃত্তি পান। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ ইংলিশ মাইনর স্কুলে (বর্তমান পিটিআই)। ষষ্ঠ শ্রেণিতেও বৃত্তি পান তিনি। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ আজিম উদ্দিন হাইস্কুলে। ১৯৪১ সালে তিনি আজিমউদ্দিন হাইস্কুল থেকে কলকাতা বোর্ডের অধীনে মেট্রিকুলেশন পাস করেন প্রথম বিভাগে। সে বছর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় মেধা তালিকায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে। সেখানে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। পিছিয়ে পড়লেন দুই বছর। এরপর ১৯৪৩ সালে কিশোরগঞ্জ কলেজে (গুরুদয়াল কলেজ) প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৫ সালে আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন আশরাফুদ্দীন। ১৯৪৭ সালে ডিস্টিংশন নিয়ে বিএ পাস করেন তিনি।
জানা গেছে, আজিমউদ্দিন হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন অহিংস গান্ধীবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আশরাফুদ্দীন। প্রথমে কংগ্রেসের একজন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিকভাবে জড়িয়ে যান। কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগ সেই সময়ের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দাম্ভিকতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান ছিল। কখনও কখনও সামন্তপ্রভুর মতো সাধারণ মানুষের ওপর তারা নিপীড়ন চালাত। সেসময় আশরাফুদ্দীন এবং আরও কিছু যুবককর্মী প্রতিবাদ মুখর ছিলেন। এই প্রতিবাদী মানসিকতার মধ্য দিয়েই প্রস্তুত হতে থাকে আগামী দিনের প্রগতিশীল নতুন রাজনীতির ক্ষেত্র।
১৯৪৩ সালে ‘কিশোরগঞ্জ কলেজে’ ভর্তি হওয়ার পর পূর্ববাংলায় দেখা দেয় খাদ্যাভাব। ’৪৩-এর মন্বন্তরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কর্মী ও কিছু কমিউনিস্ট কর্মী মিলে দুস্থ ও পীড়িত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন মৌ. আশরাফুদ্দীন। দুর্ভিক্ষের কারণে কলেরায় যখন গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে, অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, তখন তিনি তার সহপাঠী এবং রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মৃত লাশ সৎকারের কাজে নেমে পড়েন। এভাবেই তিনি ছাত্র অবস্থায় মানবসেবার ব্রত নিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন।
গুরুদয়াল কলেজে ডিগ্রি ক্লাসে পড়ার সময় ১৯৪৬-৪৭ সেশনে মনোনীত ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মৌ. আশরাফুদ্দীন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের অংশ হিসেবে সিলেট রেফারেন্ডামে কিশোরগঞ্জ থেকে একটি টিম সিলেট গমন করে, এর নেতৃত্ব দেন আশরাফুদ্দীন আহমদ। ‘মুজিব ভাই’-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে সেখানেই। ঐতিহাসিক সিলেট রেফারেন্ডাম থেকেই আওয়ামী রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ করে ‘মুজিব ভাইয়ের’ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে কিশোরগঞ্জ মহকুমায় আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা কয়েকজনের একজন হলেন আশরাফুদ্দীন আহমদ। ১৯৫১ সালে কাউন্সিলে প্রথম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন মো. জিল্লুর রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) এবং সাধারণ সম্পাদক হন মৌ. আশরাফুদ্দীন।
ভাষা আন্দোলনে কিশোরগঞ্জে ছিল তার সক্রিয় ভূমিকা। ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করার পর তিনি শিক্ষার মশাল হাতে এগিয়ে আসেন। সেই সময়ের অশিক্ষা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগ্রত করার ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হন তিনি। বিশেষত পিছিয়ে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আনার সংগ্রামের অংশ হিসেবে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুলে (কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) শিক্ষকতায় যোগদান করেন তিনি। তার শিক্ষকতার সময়েই ভাষা আন্দোলনের শুরু। একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক তার সহকর্মী সুখরঞ্জন রায়কে নিয়ে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে মানুষকে সচেতন করতে লাগলেন। তার নেতৃত্বে এবং সভাপতিত্বে মিছিল মিটিং সমাবেশ হতে থাকে। ছাত্র-যুবসমাজকে তিনি ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তার নামে হুলিয়া জারি হয়। আরও কতিপয় ভাষা সংগ্রামীর সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন।
রামানন্দ হাইস্কুলের শিক্ষকতার চাকরির ওপর প্রশাসনের খড়গ নেমে আসে। মৌ. আশরাফুদ্দীন ও সুখরঞ্জন রায়কে (অরুণবাবু) রামানন্দ হাইস্কুল থেকে পাক সরকারের স্থানীয় প্রশাসন বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ‘রায়সাহেব’ জগদীশচন্দ্র এই দুজনকে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করার কথা বললে তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে এই বিদ্যালয় পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে সময়ে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করে একপর্যায়ে দুই বন্ধু আজিমউদ্দিন হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে স্থিত হন। ১৯৫৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে আবু তাহের খান পাঠান ও মৌ. আশরাফুদ্দীন গ্রেপ্তার হন। যুক্তফ্রন্ট সেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি এবং বন্দি সাথীরা মুক্তি পায়। ১৯৫৮-এর সামরিক শাসন পর্যন্ত তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে কিশোরগঞ্জ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন, মনোনয়ন না পেয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালান। মুক্তিযুদ্ধে তার ৩য় সন্তান ছাত্রলীগ নেতা সাব্বির আহমেদ মানিক এবং বাড়ির আরও পাঁচজনকে দেশমাতৃকার জন্য অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেন। অসংখ্য ছাত্রকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বাকশাল গঠিত হওয়ার পর ২০ এপ্রিল কিশোরগঞ্জে জাতীয় সংসদের একটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোনয়নে তিনজন প্রার্থীর মধ্যে স্কুল মাস্টার মৌ. আশরাফুদ্দীন আহমদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একজন কেতাদুরস্ত আলেম মৌ. আশরাফুদ্দীন সারা জীবন মানবসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতা করেছেন, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভাষার মাসেই তিনি কিশোরগঞ্জের নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। তার পাঁচ পুত্রের মধ্যে একজন বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ও একজন সদস্য।
মন্তব্য করুন