আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচরাণায় ভোটারদের বিড়ি-সিগারেট বা অন্যান্য তামাকজাত পণ্য না দিতে দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিবিদদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমন্বয়ের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। সেই সঙ্গে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘সংশোধিত ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ’ আইনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার দাবিও জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে উন্নয়ন সমন্বয় আয়োজিত ‘ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে ড. রহমান এ দাবি জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, যেহেতু বছরটি নির্বাচনের। নির্বাচনী বছরের এই সময়ে তামাক সংশোধন আইন পাস হওয়া কতটা অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। আমি মনে করি, এই বছরটিতে জনসচেতনা অনেক বেশি হবে। আমার প্রস্তাব থাকবে, শুধু আইনটিই আমরা পাস করব না, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল—তাদের নির্বাচনী ইশতেহারও যেন এই আইনটির পক্ষে দাঁড়ায়। যেন তারা বলেন, এই আইনটি পাস হলে আমরা দলমত নির্বিশেষে এই আইনটিকে সমর্থন করব। এই চ্যালেঞ্জটিকে আমরা সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে পারি।’
নির্বাচন মানেই কিন্তু ধূমপান। আমরা যদি আগে থেকেই দাবি করি, নির্বাচনে আমরা সিগারেট দেব না, বিড়ি দেব না। কেউ যেন বিড়ি না দেয়—এই দাবিটা যদি জোরালভাবে তুলতে পারি তাহলে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে’—যোগ করেন আতিউর রহমান।
গবেষণা উপাত্ত তুলে ধরে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’-এর অধিকতর সংশোধনীর খসড়াটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেছেন ১৫৫ জন সংসদ সদস্যসহ ২০ হাজারের বেশি নাগরিক ও সংগঠন। মাথায় রাখতে হবে, এই আইনের উদ্দেশ্য হলো যারা ধূমপান করছেন না তাদের পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেওয়া এবং কিশোর-তরুণরা যেন ধূমপান শুরু করতে উৎসাহিত না হন তা নিশ্চিত করা। ফলে প্রস্তাবিত সংশোধনীটি বাস্তবায়ন করা গেলে আমাদের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি বৈশ্বিক মানে উন্নিত হবে। ’
তিনি উল্লেখ করেন, দেখা যাচ্ছে যে কেউ কেউ এই সংশোধনী চূড়ান্তকরণকে বাধাগ্রস্ত করতে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই প্রচারণাগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আইনটি বাস্তবায়ন করলে ছোট দোকানদারদের বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা নেই। কর্মসংস্থানেরও ওই অর্থে কোনো ক্ষতি হবে না বললেই চলে। বরং এই সংশোধনী চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে তার সুফল পাবে সামষ্টিক অর্থনীতিও।’
আইনের সংশোধনীটি সংসদে দ্রুত পাসের দাবি জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘একেকটি দিন দেরি হওয়া মানে আরও বিপুল সংখ্যক অমূল্য প্রাণ তামাকের কারণে হারিয়ে যাওয়া। ভুলে গেলে চলবে না—প্রতিদিন তামাকের কারণে এদেশে প্রায় 8৫০ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন।’
নাগরিক সংলাপে যোগ দিয়ে বাংলা একাডেমির সভাপতি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘সংশোধনী আইনটি পাস হলেই তামাকের সেবন ও ক্ষতিকারক প্রভাব বন্ধ হবে সেটা বলা কঠিন। তবে নতুন প্রজন্মকে যাতে তামাক সেবন থেকে বিরত রাখা যায় সেই প্রচেষ্টাটি এখন থেকেই করতে হবে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের দায়বদ্ধতা খুবই কম। জনগণের চিকিৎসায় উন্নত দেশের মতো সরকার অতিরিক্ত দায় নিতে পারে কিনা সেটা এখন ভেবে দেখা জরুরি। কেননা তখন তামাকে সেবনে স্বাস্থ্য খাতের ক্ষতিটা সরকার সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারতো এবং এর প্রতিরোধে আমরা আরও কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পেতাম।’
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ২০৪০ সালকে ঘিরে উন্নত দেশে রূপান্তরের যে লক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে, আমাদের ভাবতে হবে সেই লক্ষ্যটা কী? সেই লক্ষ্যটা কী একটি পুষ্টিহীন নেশাগ্রস্ত জাতি? আমরা যদি সত্যিকারের উন্নয়ন চাই, তাহলে কেন ‘সংশোধিত ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ’ আইন নিয়ে আমরা দ্বিধান্নিত? সমতলের পর এখন পাহাড়ে তামাক চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে। দেশে এখন ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক সেবন করছেন এবং পরোক্ষ শিকার হচ্ছেন তারও বেশি মানুষ। আমাকে যারা হত্যা করছে আমি কিছু বলব না? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দেরি করাকে অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
সংলাপে অংশ নিয়ে ‘সংশোধিত ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন’ অবিলম্বে পাসের পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী, সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ নঈমুল ওয়াদুদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর রিসার্চ ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাত, বিআইজিডির ভিজিটিং ফেলো ও উন্নয়ন সমন্বয়ের ইমেরিটাস ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ডা. রোকেয়া খাতুন রেখা, বেসরকারি টেলিভিশন বাংলা ভিশনের প্রধান সম্পাদক এ ড. আবদুল হাই সিদ্দিক, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর কোষাধ্যক্ষ খাইরুজ্জামান কামালসহ অন্যরা।
মন্তব্য করুন