ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মর্তুজা কবির মুরাদের আহীর ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে শুরু হয় এ আয়োজন। মানুষের জয়গানের মধ্য দিয়ে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ছায়ানট। ছায়ানটের আয়োজনে রমনা বটমূলে ‘স্বাভাবিকতা ও পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির সাধনা’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে রমনার বটমূলে সুরের মাধুরীতে বরণ করে নেওয়া হয়েছে নতুন বছরকে।
সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আঁধার রজনী পোহালো’, ‘ওঠো ওঠো রে’, ‘এ পথ গেছে কোন খানে’, ‘বহে নিরন্তর অনন্ত ধারা’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘উদার অম্বর দরবারে তোরি’, ‘নমঃ নমঃ নমো বাঙলাদেশ মম’, ‘কারার এই লৌহ কপাট/এই শিকল পরা ছল’ ইত্যাদি পরিবেশন করেন বড় ও ছোটদের দল।
এ ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন সত্যম্ কুমার দেবনাথ, তানিয়া মান্নান, নজরুলগীতি পরিবেশন করেন মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া, মনীষ সরকার, বিজয় চন্দ্র মিস্ত্রী, অজয় ভট্টাচার্যের কথায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন খায়রুল আনাম শাকিল, লালন সাঁইয়ের গান পরিবেশন করেন চন্দনা মজুমদার প্রমুখ। কাজী নজরুলের জীবন-বিজ্ঞান পাঠ করেন রামেন্দু মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্রাণ ও অপমাণিত পাঠ করে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। এবার আয়োজনে সম্মেলক গান ১১টি, একক গান ১৫টি এবং ২টি পাঠ ও আবৃত্তি ছিল।
ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, বাঙালির এই আয়োজন আপন সত্তাকে লালন করে। মানুষ বেড়ে উঠছে অসহিষ্ণু সমাজে। তাদের স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে হবে। নইলে বাঙালির প্রাণপ্রিয় এই নববর্ষ উদযাপন হয়ে উঠবে সাজার উপলক্ষ।
ড. মফিদুল হক বলেন, একদিকে আত্মশক্তি অন্যদিকে নবজাগরণ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে সকলের মহামিলন। বাঙালি সেই মহামিলনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে বাংলাদেশে। এই চেতনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, আনন্দের কথা হচ্ছে, ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান এখন আর ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই অনুষ্ঠান হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঙালিরা নববর্ষ উদযাপন করছেন। এটা বাঙালির সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে জায়গা করে দিয়েছে।
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, এবারের নববর্ষের প্রথম প্রভাতে, আমরা মানুষের জয়গান করেছি। এ ছাড়াও বক্তব্য দেন সহসভাপতি ড. আতিউর রহমান সহসভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দর্শকরা বর্ষবরণের আয়োজনকে উপভোগ করছিলেন।
বর্ষবরণে অংশ নেন নারী-পুরুষ শিশু সব জাতি ধর্ম, বর্ণ পেশার মানুষ। বিদেশিরাও এসেছেন বর্ষবরণ উদযাপনে অংশ নিতে। সাদা গেঞ্জি, লাল প্রিন্টের পায়জামা পরে কয়েকজন বিদেশি তরুণী গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলাচ্ছিলেন। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সঙ্গে নাচছিলেন। যেন এক অভিভূত দৃশ্য।
বর্ষবরণে দর্শক সারিতে বসেছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি বর্ষবরণ সম্পর্কে কালবেলাকে বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনে বর্ষবরণ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ। আমরা সবাই মিলিতভাবে গানগুলো গাইতে পারি।
এলিফ্যান্ট রোড থেকে এসেছেন ডা. আরিফ রিদোয়ান। ছোটবেলা বাবা, ভাইদের সাথে আজিমপুর থেকে বর্ষবরণে অংশ নিতে আসতেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, প্রতি বছর বর্ষবরণ দেখতে আসি। আগের বর্ষবরণের চেয়ে এবারের বর্ষবরণে ভিন্নতা এসেছে। বর্ষবরণের গানের বৈশিষ্ট্যের যেমন পরিবর্তন হয়েছে। তেমনি সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে। এবারে বর্ষবরণে ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি পরিবেশন করা হয়নি।
রামপুরা থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন ছন্দারিনা গীতি। তিনি কালবেলা বলেন, এবারের লোক সমাগম ভেবেছিলাম ঈদের পর হওয়ায় কম হবে। কিন্তু প্রাণের টানে অনেকেই চলে এসেছেন ছায়ানটের বর্ষবরণ উদযাপনে শামিল হতে।
মন্তব্য করুন