শিতাংশু ভৌমিক অংকুর
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪২ পিএম
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বৃষ্টির আশায় দেশজুড়ে চলছে যত আয়োজন

বৃষ্টির আশায় ব্যাঙের বিয়ে। পুরোনো ছবি
বৃষ্টির আশায় ব্যাঙের বিয়ে। পুরোনো ছবি

বৃষ্টির আশায় নানা আয়োজনে নানা জনের নানান ধরণের প্রার্থনা। বিশেষ নামাজ-মোনাজাত ও বৃষ্টির আশায় ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন উভয়ই বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীনকাল থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বাংলার মানুষ বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় থেকেছে। শুধু অপেক্ষাই করেনি। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষার পাশাপাশি করেছেন নানা আয়োজন।

বাংলা সংস্কৃতির পথ ও পরিক্রমায় মৌর্য শাসন আমল থেকে মুঘল শাসন আমল ও আজকের বাঙালি সংস্কৃতির সব কিছু আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভর। তাই আমাদের দেশের সমস্ত উৎসব-প্রার্থনা প্রায় সকল আয়োজন প্রাণ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। যখনই অনাবৃষ্টি-খরা, ঝড়-বন্যার মতো দুযোর্গ নিয়ে প্রকৃতির বিমাতাসুলভ রুদ্র আচারণ আমাদের আহত করে ঠিক তখনই দেশের গ্রামেগঞ্জে হাজার বছরের প্রার্থনার ঐতিহ্যকে ধারণ করে মানুষ নানাভাবে প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে।

শহর, বন্দর, গ্রাম-সব জায়গায় গ্রীষ্মের রুদ্ররোদ। প্রচণ্ড তাপে গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ, হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন মানুষ। তীব্র গরমে ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। দাবদাহ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোগবালাইও বাড়ছে। গরম থেকে বাঁচতে নদী-খাল-বিল ও ডোবায় নামছে মানুষ, ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বত্র হাঁসফাঁস অবস্থা; এই অবস্থা থেকে বাঁচতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় করেছে মানুষ।

মঙ্গলবার সারা দেশে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকার ওয়ারীতে ছাপাখানার কর্মী, ময়মনসিংহে শিলপাটার কর্মী ও মিল শ্রমিক, কুমিল্লায় রাজ জোগালি, জামালপুরে ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। হিট স্ট্রোকজনিত কারণে এদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া গরম থেকে বাঁচতে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে নেমে তিন শিশু মারা গেছে। এমন পরিস্থি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন বৃষ্টির আর এই বৃষ্টি নামানোর জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাঙের বিয়ে, ইস্তিস্কার নামাজ, তালতলার শিন্নি, মেঘ পূজা, হুদমা গান, কুলা নামানি, পুণ্যিপুকুর ব্রতের মতো নানা আয়োজন করা হয়।

ব্যাঙের বিয়ে : 'ব্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গির বিয়ে, কুলো মাথায় দিয়ে/ ও ব্যাঙ জল আন গিয়ে আন গিয়ে/ খালেতে নাই জল/ বিলেতে নাই জল/ আকাশ ভেঙে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল।'এমনটাই গাইতে গাইতে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয় কোনো বিল বা জলাশয় থেকে ধরে আনা একজোড়া ব্যাঙকে। ব্যাঙের মাথায় থাকে টোপর, নারীরা শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে ব্যাঙের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দেন। বিয়ে উপলক্ষে চলে ভুরিভোজও।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টির দেবতা বরুণ দেব সন্তুষ্ট হয়ে শিগগির পর্যাপ্ত বৃষ্টি নামাবেন এবং ওই বছর ধানের উৎপাদন ভালো হবে। অনাবৃষ্টি ও খরার দরুন দেশের নানা অঞ্চলে আজও ব্যাঙের বিয়ে সমারোহে পালিত হয়ে থাকে। কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই নয়, ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয় পাহাড়ি সমাজেও। অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ব্যাঙের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদার মতো সবজি ও চাল সংগ্রহ করে। এরপর বিয়ের আয়োজনকারী বাড়ি গোবর দিয়ে লেপে পবিত্র করে ব্যাঙের বিয়ে আয়োজন করা হয়। আয়োজন শেষে মহা ধুমধামের মাধ্যমে খাবার পরিবেশন করা হয়।

ইস্তিস্কার নামাজ : ‘ইস্তিস্কা’ শব্দের অর্থ পানির জন্য প্রার্থনা করা। খরা বা দাবদাহের অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আকুতি ভরে বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে হয়। এই নামাজকে ইস্তিস্কার নামাজ বলে। পরপর তিন দিন ইস্তিস্কার নামাজ পড়া সুন্নত। যদি ইতিমধ্যে বৃষ্টি হয়েও যায়, তবু তিন দিন করা উত্তম। এই তিন দিন নফল রোজা রাখা মুস্তাহাব।হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের মাঠের দিকে বের হয়ে গেলেন, অতঃপর ইস্তিস্কা (আল্লাহর কাছে পানি তলব) করলেন। তিনি কিবলামুখী হলেন। তাঁর চাদর উল্টিয়ে পরলেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)। ইস্তিস্কার নামাজের সময়: সূর্যোদয়ের পর ২০ মিনিটের মতো সময় অতিবাহিত হলে ইস্তিস্কার নামাজ পড়তে হয়, ইশরাক নামাজ ও ঈদের নামাজের সময়ের মতো।

তালতলার শিন্নি : বাংলার কৃষি প্রধান অঞ্চলে তালতলার শিন্নি বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি আয়োজন। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ, চাল, গুড় চাঁদা হিসেবে তোলা হয়। কেউ কেউ অর্থ সাহায্যও করে। সংগৃহীত রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের সবচেয়ে উঁচু গাছের তলায়। এরপর হাঁড়িতে চড়িয়ে রান্না করা হয় শিন্নি।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উঁচু গাছ তালগাছ হওয়ায় এটি তালতলার শিন্নি হিসেবেই পরিচিত। অনেক অঞ্চলে খিচুড়িকেও শিন্নি নামে ডাকা হয়। তালতলা শিন্নি খাওয়ার জন্য গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ গাছতলায় জড়ো হয়। রান্না শেষে উপস্থিত গ্রামবাসীদের কলাপাতায় শিন্নি বিতরণ করা হতো। খাওয়ার পর উপস্থিত গ্রামবাসী বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে।

কাদা মাখানো কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টি নামানোর জন্য কাদা মাখানোরও চল রয়েছে। মেয়েরা পানি ভর্তি কলসি নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। তারা শুকনো উঠোনে পানি ঢেলে কাদা তৈরি করে একে অন্যের গায়ে কাদা ছিটিয়ে দেয়।

মেঘ পূজা : উত্তরবঙ্গে অনাবৃষ্টির সময় বৃষ্টি নামানোর জন্য লোকজ পূজার নাম হুদুমদ্যাও পূজা বা মেঘ পূজা। এ উপলক্ষে নৃত্য-গীতেরও আয়োজন করা হয়। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখ মাসের শুরুতে এই লোকপূজার আয়োজন করা হয়।ফিঙে পাখির বাসা, কলাগাছ, পানিভর্তি একটি ঘট, কুলো, পান-সুপারি, বরণ ডালা, ধুপ এবং পূজার নানাবিধ সরঞ্জামাদি নিয়ে হুদুমদ্যাও পূজার আয়োজন করা হয়। মেঘ পূজায় পুরুষদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এটি নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

হুদমা গান : বৃষ্টি নামানোর জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজন রাতে দলবেঁধে হুদমা গান গেয়ে থাকেন। তাদের বিশ্বাস, হুদমা মেঘের দেবতা। যদি দেবতা হুদমাকে সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে তিনি চাষের উপযুক্ত বৃষ্টির বর্ষিত করবেন।

কুলা নামানি : গ্রাম বাংলায় বৃষ্টির জন্য কৃষকদের এক লোকজ অনুষ্ঠানের নাম কুলা নামানি। প্রথমে নতুন একটি কুলায় ধান, বিভিন্ন বনফুল, ধান, দূর্বাঘাস এবং কাকের বাসার কাঠখড় দিয়ে সাজানো হয়। গ্রামের কোনো এক কিশোর বা কিশোরীর মাথায় সেই কুলা তুলে দেওয়ার আগে একটি কাঁসার কলসির উপর কুলাটি রাখা হয়। কলসিতে থাকে সোনা-রূপা ভেজানো পানি। সঙ্গে থাকে একটি আমগাছের ডাল।কুলা বহনকারী সেই কিশোর/ কিশোরীর মুখে মাখানো থাকে সাদা চুন ও কালি। এ চুন-কালি দিয়ে মেঘের প্রতীক। কুলা বহনকারীর পেছনে সারিবদ্ধভাবে আসতে থাকে বাকি কিশোর, বালকরা। তাদের মুখেও চুন-কালি থাকে। কুলা নামানির দলের সঙ্গে থাকেন কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ গ্রামবাসীও।কুলা নামানি বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চাল, ডাল, তেল মশলা, শাকসবজি বা টাকা পয়সা চাঁদা হিসেবে তোলে। তাদের জিনিসপত্র দেওয়ার সময় বিভিন্ন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা কুলা নামানির দলকে দিয়ে ভিজিয়ে দেন। তখন সবাই বৃষ্টির গান ধরে বৃষ্টি নামানোর জন্য প্রার্থনা করে। এমনই একটি গান 'আল্লাজিরা, তেওল্লাজিরা, বাঁশপাতার ভাই/ এমন বরণ বইরা যাবি ভিজ্জা বাড়ি যাই'। গান গাইতে গাইতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগৃহীত চালডাল ও আনাজপত্র নিয়ে কোন এক বাড়ির উঠানে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করা হয়। রান্নার সময়ও উপস্থিত সবার মুখে মুখে থাকে বৃষ্টির গান। খিচুড়ি রান্না শেষে তা আগত সবাইকে খেতে দেওয়া হয়।

পুণ্যিপুকুর ব্রত : গ্রামবাংলায় বৃষ্টি নামানোর আরেকটি প্রথা 'পুণ্যিপুকুর ব্রত'। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আচার।বৃষ্টি নামানোর পাশাপাশি বৃষ্টির অভাবে এবং তীব্র সূর্যতাপে যেন পুকুর না শুকিয়ে যায়, গাছপালা না মারা যায় এবং ফসলের ফলন ভালো হয় সেজন্য ১ মাসব্যাপী এই ব্রত পালন করা হয়। ৫ থেকে ৯ বছরের মেয়েরা এই ব্রত পালন করে থাকে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে বিবাহিত নারীরাও অংশ নেন ব্রতে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৮০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতানো কোচ মারা গেছেন

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

চিকিৎসকের পা ধরে মাফ চাইলেন সেই আ.লীগ নেতা

লক্ষ্মীপুরে কারাগারে ২১ জেলে

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বাছাইয়ে সিরাজগঞ্জের অয়ন

যান চলাচলের অপেক্ষায় চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

পুলিশ বক্সের সামনেই অটোরিকশা স্ট্যান্ড, টাকা দিলেই মেলে চালানোর অনুমতি

রাজধানীতে ৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড

পদ্মায় চলছে রেণু পোনা নিধনের মহোৎসব

১০

মারা গেলেন ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ খ্যাত অভিনেতা বার্নার্ড হিল

১১

মুন্সীগঞ্জে ওসিসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা

১২

ছেলের বিরুদ্ধে ভোট করায় ডিও লেটার না দেওয়ার হুমকি এমপির স্ত্রীর

১৩

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে নদভী

১৪

‘এখনো জানা যায়নি সুন্দরবনে আগুনের কারণ’

১৫

সেতুতে বিশাল গর্ত, আতঙ্কে এলাকাবাসী

১৬

নদী শাসনে নিম্নমানের জিও ব্যাগ ব্যবহারের অভিযোগ

১৭

চশমা ছাড়াই কোরআন পড়েন ১৩৫ বছর বয়সী তাম্বিয়াতুন নেছা

১৮

রাজধানীতে শিলাবৃষ্টি

১৯

বাটারবন খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে শিশু

২০
*/ ?>
X