ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি বালক আহমেদ উত্তর গাজায় তার পরিবারের রান্নাঘরে একটি খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছিল, ঠিক তখনই পাশের অ্যাপার্টমেন্টে ইসরায়েলি বিমান হামলা হয়। বিস্ফোরণে জানালা ভেঙে যায়, তার পা এবং পিঠে কাঁচ বিঁধে যায়। মা মরিয়ম তাকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবন্ত বের করে আনেন, তার হাত রক্তে ভিজে যায়। আহমেদকে আল-শিফা হাসপাতালে (গাজার বৃহত্তম, তখন কোনো রকম চলছে) নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জরুরি চিকিৎসা কক্ষটিতে ভিড় উপচে পড়েছিল; ৫০ জন রোগী একটি ঘরে।
শিশু সার্জন ডা. ইউসুফ আল-খালিদি ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আহমেদের ক্ষত গভীর ছিল, কিন্তু জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো কিছু ছিল না। আমরা তার ক্ষত সেলাই করেছিলাম, কিন্তু জরুরি বিভাগের অবস্থা ছিল দুঃস্বপ্ন। হাত ধোয়ার জন্য জল ছিল না। পরিষ্কার গজ ছিল না। আমরা স্যালাইন বা রক্ত দেওয়ার পাইপ পুনর্ব্যবহার করছিলাম। তাতে কী মারাত্মক ঝুঁকি, জানতাম, কিন্তু আমাদের কী উপায় ছিল? তিন দিন পর তার জ্বর ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল।’ সেলাই থেকে সবুজ-হলুদ পুঁজ বের হচ্ছিল। পরীক্ষায় পাওয়া গেল অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বওম্যানিয়াই একটি ‘সুযোগসন্ধানী’ ব্যাকটেরিয়া, যা ২০১৮ সাল থেকে গাজার ওয়ার্ডগুলোকে তাড়া করছে। ডাক্তারদের কলিস্টিন (কলিস্টিন একটি বিষাক্ত কিন্তু কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক) প্রয়োজন ছিল। কিন্তু গাজার ফার্মেসিগুলোতে কোনো ওষুধ ছিল না- মিসর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। আহমেদের কিডনি বিকল হতে শুরু করে। এদিকে ডায়ালাইসিস মেশিন নষ্ট; একজন নার্স খুচরা যন্ত্রাংশ দিয়ে আহমেদের রক্ত ফিল্টার করছিলেন। এর ফলে সে ৪৮ ঘণ্টা সময় পেয়ে গেল। কিন্তু কলিস্টিন ছাড়া এটি চায়ের পেয়ালার জল দিয়ে দাবানলের সাথে লড়াই করার মতো ছিল। ভোর ৩:১৭ মিনিটে আহমেদ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার মা পাগলিনীপ্রায়, কোনো কান্নাকাটি নেই- শুধু এদিক-ওদিক দোল খাচ্ছিলেন, ফিসফিসিয়ে বলছিলেন, ‘এটা মিসাইল ছিল না।’ মর্গে তার ট্যাগে লেখা ছিল : ‘মৃত্যুর কারণ : ইনফেকশন অর্থাৎ সংক্রমণ (এ. বওম্যানিয়াই)’, যুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই। ঘটনাটি সত্যি; ঘটেছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের এক বৃহস্পতিবার। নৈতিকতা/গোপনীয়তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স এবং ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের নথিভুক্ত অগণিত মর্মান্তিক ঘটনাকেই প্রতিফলিত করে।
যে জিনিসটি আহমেদকে হত্যা করেছিল তা সরাসরি আকাশ থেকে আসেনি, বরং এটি হাসপাতালে অপেক্ষা করছিল। নীরবে আক্রমণকারী যে জীবাণু তাকে হত্যা করল, তাকে আগেই হত্যা করা যেত, যদি ঐ অ্যান্টিবায়োটিকটি পাওয়া যেত। গাজায় ব্যাকটেরিয়া/ভাইরাস ‘অদৃশ্য সেনাবাহিনী’র মতো কাজ করছিল, যা যুদ্ধের বিশৃঙ্খলাকে কাজে লাগিয়ে মানবঘাতকদের মতোই নির্মম আচরণ করছিল।
বস্তুত গুলিবর্ষণ বন্ধ হলেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় না। কবি নির্মলেন্দু গুন লিখেছিলেন, ‘আমরা সশস্ত্র হব অজস্র মৃত্যুতে’। যুদ্ধসৃষ্ট সামগ্রিক দুরবস্থা সশস্ত্র করে তোলে জীবাণুদের। তারা জীববিজ্ঞান কষে কষে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কোষে কোষে যুদ্ধ চালিতে যেতে থাকে। মিউটেশনের ফলে জীবাণুরা এমনরূপে আবির্ভূত হয় যাদের বিরুদ্ধে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ডব্লিউএইচও স্বাস্থ্য ক্লাস্টার রিপোর্ট (মার্চ ২০২৪)-এর ‘অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চল’ অধ্যায়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গাজার যুদ্ধে আহতদের ৪৭ শতাংশ ‘হাসপাতালে-অর্জিত সংক্রমণে’ (hospital acquired/nosocomial infection) আক্রান্ত হন এবং আঘাতজনিত অঙ্গচ্ছেদের ৭০% ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী সংক্রমণ দেখা দেয়; সংক্রমণকারী জীবাণুর নাম অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বওম্যানিয়াই এবং বহু-ঔষধ-প্রতিরোধী সিউডোমোনাস (pseudomonas)। মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স (এমএফএস)-এর রিপোর্ট (ফেব্রুয়ারি ২০২৪) মোতাবেক ‘গাজায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ একটি নীরব যুদ্ধ; গুরুতর ইনফেকশনের জন্য কার্বাপেনেম (যেমন- মেরুপেনেম) প্রথম সারির অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বওম্যানিয়াইয়ের বিরুদ্ধে এর কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়ার মুখে। ফলে ‘সেখানে কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বওম্যানিয়াই (ক্যাব)’-এর সেপসিসে মৃত্যুর হার ৬০-৭০%। অথচ যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকায় এবং আইসোলেশন প্রোটোকল অনুসরণ করার ব্যবস্থা থাকায় ইউরোপীয় দেশের আইসিইউতে মৃত্যুর হার ১৫-২০%।’ এই একই ব্যাকটেরিয়া ইরাকে (২০০৩-২০১০) মার্কিন সেনাদের ফিল্ড হাসপাতালে সংক্রমিত হয়েছিল।
এমন প্রেক্ষাপটে ‘শরণার্থী-ব্যাকটেরিয়া’ (bacterial refugee) শব্দযুগল বিশ্বজুড়ে আলোচনায় চলে এসেছে। এগুলো রোগ সৃষ্টিকারী এমন সব জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী) যেগুলো যুদ্ধের ফলে স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবনযাপন ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরা গাজা, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইউক্রেন এবং অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে মহামারিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। যুদ্ধ কীভাবে ‘শরণার্থী-ব্যাকটেরিয়া’ তৈরি করে তার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নরূপ :
১. বিপর্যস্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা : বোমার আঘাতে নর্দমা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়, সেখান থেকে বর্জ্য পদার্থ (মল-মূত্র-শ্লেষ্মা ইত্যাদি) ঢুকে পানীয় জলকে দূষিত করে ফেলে। কলেরা (ভিব্রিও কলেরা), আমাশয় (শিগেলা), হেপাটাইটিস-এ এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। ২০১৬-২০২৩ সালে ইয়েমেনে কলেরার প্রাদুর্ভাব আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ কলেরা মহামারি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে (২.৫ মিলিয়নের বেশি রোগী); সৌদি আরবের অবরোধের ফলে জল সরবরাহের ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো এমন নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ইউক্রেনে অবরোধের অধীন থাকা হাসপাতালগুলোয় (যেমন- মারিউপোলে) রক্তনালিতে স্যালাইন দেওয়ার সরঞ্জামাদি বৃষ্টির জল দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার কারণে ২০২২ সালে অ্যাসিনেটোব্যাক্টর মহামারি দেখা দেয়।
২. জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্র : আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বায়ুবাহিত রোগের (যক্ষ্মা, হাম, কোভিড-১৯) জন্য পেট্রি ডিশে (petri dishes) পরিণত হয়। গাজায় ‘ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা’ (ইউএনআরডব্লিউ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়, যেখানে একটি টয়লেট ১০-এর অধিক পরিবারের ভাগাভাগি করার কারণে স্ক্যাবিস, মেনিনজাইটিস এবং ‘অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকক্কাসে’র (MRSA) প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
৩. অপুষ্টি : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে ফেলে। অবরোধ (যেমন- সিরিয়ার মাদায়ায়) অসংখ্য মানুষকে অনাহারে রাখে, তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, সাধারণ হালকা সংক্রমণও মারাত্মক হয়ে ওঠে। প্রোটিনের ঘাটতির কারণে ‘ওয়ারজোন কোয়াশিওরকর’ সৃষ্টি হয়, ফলে শিশুদের ই. কোলাই নামক ব্যাকটেরিয়াজনিত মারাত্মক ডায়রিয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
৪. অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু : ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেনিসিলিনের ঘাটতির কারণে ডাক্তাররা ডোজ রেশন করতে বাধ্য হন, যার ফলে সুচিকিৎসার সাথে আপোষ করা হয় (যেমন- ব্যাকটেরিয়া কালচারের পুনঃব্যবহার); ফলে সৈন্যদের মধ্যে ইনফেকশনজনিত মৃত্যুহার গগনচুম্বি হয়। ১৯৪৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেনিসিলিন বিতরণের ক্ষেত্রে ডি-ডে সৈন্যদের জন্য অগ্রাধিকার প্রদান করে, যার ফলে বেসামরিক নাগরিকরা সেপসিসে মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উল্টো ঘটনা ঘটে। পেনিসিলিনের অতিরিক্ত ব্যবহার প্রথম প্রজন্মের ‘সুপারবাগে’র জন্ম দেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে নকল/মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকের মরিয়া ব্যবহার শুরু হয় (ঘাটতির কারণে), যার ফলে ব্যাকটেরিয়াগুলো অচিকিৎস্য ‘সুপারবাগে’ রূপান্তরিত হয়, যা প্রায় সব ওষুধ-প্রতিরোধী। গাজার কালোবাজারে প্রাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক জীবননাশক অ্যাসিনেটোব্যাক্টরের জন্ম দেয়। সিরিয়ায় ‘ভৌতিক ফার্মেসি’ (phantom pharmacies) থেকে ভেজাল অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়, যা ‘বহু-ঔষধ-প্রতিরোধী টাইফয়েড’ এবং যক্ষ্মা তৈরি করে। পোল্যান্ডে স্থাপিত শিবিরগুলোতে ইউক্রেনিয়ান শরণার্থীদের বদৌলতে ২০২৩ সালে ‘বহু-ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মার (MDR-TB) রিপোর্ট পাওয়া যায়।
৫. প্রাচীন রোগের পুনরুত্থান : টিকা অবকাঠামো ধ্বংসের কারণে সিরিয়ায় ২০১৩ সালে পোলিওর প্রাদুর্ভাব ফিরে আসে (১৯৯৯ সালে নির্মূল করা হয়েছিল)। গাজায় বর্তমানে অসংগৃহীত আবর্জনার স্তূপ থেকে লেইশম্যানিয়াসিস (মাংস ভক্ষণকারী পরজীবী) সম্পর্কে রিপোর্ট পাওয়া যায়।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো আরোপিত হয়েছিল ‘ঔষধ অবরোধ’। কার্বাপেনেম যেখানে অকার্যকর, কোলিস্টিন সেখানে ফলপ্রসূ। গাজার শেষ অবলম্বন এই কোলিস্টিন ২০২২ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য ইসরায়েলি চেকপয়েন্টে নতুন চালান আটকে রাখা হয়েছিল। আবার ‘দ্বৈত-ব্যবহার’ (duel-use)-এর আশঙ্কাতেও মিসর ও ইসরাইল গাজায় চিকিৎসা সরবরাহ সীমিত করে দিয়েছিল। দ্বৈত-ব্যবহার বলতে এমন জিনিসপত্র (ওষুধসহ) বোঝায় যা বেসামরিক এবং সামরিক উভয় উদ্দেশ্যেই কাজ করতে পারে। যেমন- কোলিস্টিনের বেসামরিক ব্যবহার হচ্ছে তা অ্যাসিনেটোব্যাক্টরের মতো ওষুধ-প্রতিরোধী ইনফেকশন নিরাময় করতে পারে; কিন্তু সামরিক উদ্বেগ হচ্ছে এটি জৈব অস্ত্র (যেমন- অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী স্ট্রেন) তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে। হাইড্রোজেন পারক্সাইডের বেসামরিক ব্যবহার হচ্ছে ক্ষত জীবাণুমুক্ত করা; আর সামরিক উদ্বেগ হচ্ছে বিস্ফোরকের উপাদান হিসেবে কাজে লাগানো। তাছাড়া হামাস এগুলোর মাধ্যমে লাভবান হতে পারে এই আতঙ্কও আবরোধের যুক্তি হিসেবে খাড়া করা হয়েছিল। ডব্লিউএইচওর রিপোর্ট (২০২৩) অনুযায়ী গাজায় চিকিৎসা সরবরাহের উপর ইসরায়েলি অবরোধের ফলে চিকিৎসার অযোগ্য ক্র্যাব সংক্রমণ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। দ্য ল্যানসেট (২০২৩) জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলের অবরোধ নীতি গাজার ক্র্যাবকে দমন করার ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেয়, হাসপাতালগুলোকে ওষুধ-প্রতিরোধী ইনফেকশনের প্রজননক্ষেত্রে পরিণত করে। অবরোধের ফলে ইউক্রেনেও ইনসুলিন ও কেমোথেরাপি চিকিৎসা ব্যাহত হয়েছে।
তবে গাজায় মানুষ হত্যা করার জন্য ব্যাকটেরিয়ার এখন আর হাসপাতালের প্রয়োজন নেই। কারণ ইসরাইল সব হাসপাতাল ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে; কাতারে কাতারে তাঁবু আর বেশ কিছু DIY (Do-It-Yourself) ফিল্ড ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। এগুলো হয়েছে জীবাণুদের নতুন ইনকিউবেটর। অ্যাসিনেটোব্যাক্টর জনাকীর্ণ, আর্দ্র, নোংরা, অ্যান্টিবায়োটিক-সিক্ত এবং অক্সিজেন-ঘাটতিতে ভোগা পরিবেশ পছন্দ করে; এমন পরিবেশ তাদের বংশবৃদ্ধির ঊর্বর ক্ষেত্র। ২০২৩-২৪ সালে ১৫ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি রাফাহতে ভিড় জমায় (মিশরের সীমান্তের কাছে)। রাফাহর প্লাস্টিকের তাঁবুশিবিরে ১টি টয়লেট ৫০০ জন ব্যবহার করছে। জ্বালানি অবরোধ ও অবকাঠামো ধ্বংসের কারণে বিদ্যুৎ নেই, ফলে অটোক্লেভ (জীবাণুমুক্তকরণ যন্ত্র) কাজ করে না; সার্জনরা গ্লাভস পুনরায় ব্যবহার করেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা কাঁচি, সূচ ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করার জন্য ভিনেগার ব্যবহার করছেন। অক্সিজেন-ট্যাঙ্ক শূন্য; ভেন্টিলেটরগুলো (যা অক্সিজেন/বাতাস প্রবাহিত করে, আবার অ্যাসিনেটোব্যাক্টরও ছড়ায়) মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এসব এলাকায় অ্যাসিনেটোব্যাক্টর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত সংক্রামক রোগ সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, প্রতিবেশী, এমনকি দূরবর্তী দেশগুলোতে বিস্তার লাভ করছে। সিরিয়াতে যে পোলিও পুনরায় আবির্ভূত হয় তা পরের বছর (২০১৪ সালে) ইরাক ও লেবাননে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের নর্দমার তরল বর্জ্যে শনাক্তকৃত হয়। সিরিয়ার শরণার্থীদের মাধ্যমে বহু-ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মা জার্মানি, গ্রিস এবং জর্ডানে ছড়িয়ে পড়ে, ২০১৫ সাল থেকে এখনো তা পাওয়া যাচ্ছে। একই দেশের শরণার্থীরা জর্ডানে বহু-ঔষধ-প্রতিরোধী টাইফয়েডও বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। ইয়েমেনে যে ভয়াবহ কলেরা মহামারি সংঘটিত হয়েছিল তা সৌদি আরব, জিবুতি ও সোমালিয়াতে এবং ডিপথেরিয়া (২০১৭-১৮) সৌদি আরব ও সুদানে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০২২ সাল থেকে যুদ্ধজর্জরিত ইউক্রেনীয় হাসপাতালগুলোতে CRAB Ges MRSA- এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়; পরবর্তীতে পোল্যান্ড, জার্মানি এবং মলদোভাতে শরণার্থীদের মধ্যে রোগগুলো শনাক্ত করা হয়।
ফলে দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সৃষ্ট রোগগুলো স্থানীয় স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে থাকছে না, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এটি প্রমাণ করে যে, আধুনিক যুদ্ধ জৈব-চিকিৎসা বিপর্যয়ের জন্ম দেয় এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলো ‘সুপারবাগ’ রপ্তানি করে থাকে। ডব্লিউএইচও গাজাকে আঞ্চলিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ‘টিকিং বোমা’ বলে অভিহিত করেছে এবং গাজা-মিসর সীমান্তে ‘শরণার্থী ব্যাকটেরিয়া’র মহামারি সংক্রান্ত সতর্ক বার্তা জারি রেখেছে।
যুদ্ধের আঘাত (মানসিক চাপ, অপুষ্টি, রোগজীবাণু) মানবদেহের ডিএনএতে অদৃশ্য ক্ষত রেখে যায়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে; জিনের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন (epigenetic changes) ঘটিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্বাস্থ্যের ক্ষতি প্রেরণ করতে পারে। অনেক আধুনিক যুদ্ধের মতো ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে রাসায়নিক এজেন্ট, ভারী ধাতু (গোলাবারুদ থেকে) এবং পরিবেশগত দূষণ (যেমন- ইউরেনিয়াম-ক্ষয়প্রাপ্ত অস্ত্র) জড়িত। এগুলো ক্যানসারের হার বৃদ্ধি, জন্মগত ত্রুটি এবং প্রজন্মগত আঘাতের কারণ হতে পারে। যুদ্ধ মানসিক স্বাস্থ্যেকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে; যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী চাপ মস্তিষ্কের রসায়নকে পরিবর্তন করে (যেমন- কর্টিসলের অব্যবস্থাপনা), যা প্রজন্মান্তরে ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে’র (PTSD) দিকে পরিচালিত করে। এ যেন সরব যুদ্ধের পর নীরব যুদ্ধ।
অস্ত্রের মাধ্যমে যে উপচার (উপশম), তাকে বলে অস্ত্রোপচার, ইংরেজিতে operation। কিন্তু বিশ্বজুড়ে যে যুদ্ধ চলছে তার অস্ত্রোপচার হচ্ছে না, অস্ত্রের পাচার চলছে, বৈধ এবং অবৈধভাবে। তাতে এই পৃথিবীর অসুস্থতার উপশম তো হচ্ছেই না, বরং নতুন নতুন রোগে সে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশের সাথে দেশের যুদ্ধ চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। কিন্তু রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ? তারা রূপ বদল করে ফেলে। আর এখন গাজা-সিরিয়া-ইউক্রেনের সুপারবাগগুলোর দখলে রয়েছে বিশ্বভ্রমণের পাসপোর্ট। ২০২৩ সালে গাজা-সিরিয়া-ইউক্রেনের হাসপাতাল বা তাঁবুগুলো ছিল মৃত্যুফাঁদ। ২০২৪ সালে দেখা যাচ্ছে- মৃত্যুর নির্দিষ্ট কোনো ফাঁদ নেই, এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২৫ সালে বড় আকারে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- গাজা-সিরিয়া-ইউক্রেনের স্বাস্থ্যসংকটের শিকার কি গোটা পৃথিবী হতে যাচ্ছে? যুদ্ধ আমাদের জীববিজ্ঞান ধ্বংসাত্মকভাবে পুনর্লিখন করে যাচ্ছে, শান্তি কি এর বিপরীত কাজটা করে দেখাতে পারে না? যুদ্ধ জীববিজ্ঞানকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, শান্তিকে অবশ্যই তা নিরস্ত্র করতে হবে। সিদ্ধান্ত আমাদের।
লেখক : বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ, জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, গীতিকার এবং প্রবন্ধকার
মন্তব্য করুন