বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সফল হয়। ছাত্র আন্দোলনের পর উদ্ভূত অরাজক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে তারা নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করে এবং ২০২৬ সালের অবাধ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে উদ্যোগী হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা ব্যর্থতা
সংবিধান সংস্কারের জন্য বিশেষ কমিশন গঠন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের কিছু প্রচেষ্টা এবং নারী কর্মকর্তাদের পুরনো প্রটোকল বাতিলের মতো সামাজিক পরিবর্তনগুলো জনগণের নজর কাড়ে। রাজনৈতিক পক্ষপাত এড়িয়ে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার জন্য কিছু নীতিমালা গ্রহণ করাও ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা যায়।
অন্যদিকে, এই সরকারের বড় সমালোচনা হলো সংবিধানের বাইরে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পর্যাপ্ত সমঝোতার অভাব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং গ্রামীণ এলাকায় অপরাধ বৃদ্ধি পায়। নির্বাচনের সময়সূচি ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
আগামী নির্বাচন ও তারুণ্য নির্ভর নেতৃত্ব
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের জন্য যে নির্বাচন পরিকল্পনা করছে, তা তরুণদের নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, সেটিই প্রমাণ করেছে যে তরুণ প্রজন্ম দেশের রাজনৈতিক রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাচনের জন্য নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি ও সংস্কারমূলক পরিকল্পনায় তারুণ্যের কণ্ঠস্বরকে প্রাধান্য দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ভোটারদের বড় অংশই তরুণ, তাই তাদের স্বপ্ন, কর্মসংস্থান এবং প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি আগামী নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দু হবে।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পুরোপুরি তরুণ নেতৃত্বে আস্থা রাখতে পারছে না। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং জনসংযোগের ঘাটতি অনেক নতুন নেতাকে পিছিয়ে দিতে পারে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার যদি স্বচ্ছ নির্বাচন এবং নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে, তবে ২০২৬ সালের নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন
বর্তমান বাংলাদেশের জন্য আমি একজন তরুণ প্রজন্মের কর্মী হিসেবে খুবই উদ্বিগ্ন, কারণ একটাই– আমরা আমাদের আগামী দিনের বাংলাদেশে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে গত ১৬ বছর ধরে এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে পঙ্গু করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হয়নি। আর মূলত ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকেই আমাদের প্রতিনিধি গড়ে ওঠে এবং নেতৃত্ব তৈরি হয়। সেই কাজটি গত আওয়ামী লীগ সরকার করেনি, আসলে নেতৃত্ব সংকট তৈরি করে রেখেছিল পরিকল্পিতভাবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে দেশ বরণ্য ব্যক্তি ড. মোহাম্মদ ইউনূস তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেবে, যার মাধ্যমে আমাদের নেতৃত্ব তৈরি হবে। কিন্তু তিনি আসলে গত এক বছরে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা আসলেই উদ্বিগ্ন, তরুন সমাজ উদ্বিগ্ন, আগামী দিনে এই নেতৃত্ব শূন্যতা দিয়ে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি খুব স্পষ্ট, আগামীর বাংলাদেশ অত্যন্ত ভয়ংকর প্রজন্ম অপেক্ষা করছে, যে প্রজন্ম রাজনীতিতে সচেতন নয়, যে প্রজন্ম নেতৃত্ব তৈরি করছে না, যে প্রজন্ম শিক্ষিত নয়। এই প্রজন্মকে সত্যি অর্থে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, সত্যি অর্থে, একটি কষ্টদায়ক হবে আমাদের জন্য। হাতে গোনা উপমহাদেশের যে কয়েকজন রাজনীতিবিদ আছেন, তাদের মধ্যে আমরা বাংলাদেশে এখন খুব কম দেখতে পাচ্ছি। আজ দেখুন, বাংলাদেশে এখন তরুণদের মধ্যে শিক্ষিত ও মার্জিত মানুষ হাতে গোনা দু-চার জন আছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ব্যারিস্টার আনদালিব রহমান পার্থ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই সচেতন এবং শিক্ষিত, মার্জিত মানুষগুলো যখন নেতৃত্বে এবং রাজনীতিতে আসবে, তখনই আগামী দিনে সুন্দর, বাসযোগ্য, আধুনিক একটি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে আমরা পরিচিত করতে পারব।
বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও সংস্কার
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও সংস্কার একসাথে চলছে। একদিকে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত নানা ষড়যন্ত্র সক্রিয়, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংস্কার ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি নতুন কাঠামো গড়ার চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংবিধান সংস্কার, দুর্নীতি দমন, এবং শিক্ষা খাতে পরিবর্তনের মতো উদ্যোগগুলো সংস্কারের অংশ।
তবে এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, গুজব ছড়ানো, এবং বিভাজনমূলক রাজনীতি। অনেকেই সংস্কারকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে, ফলে দেশজুড়ে অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংস্কারের সফলতা নির্ভর করছে জনগণের ঐক্য, স্বচ্ছ প্রশাসন, এবং তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের ওপর।
এনসিপির ভবিষ্যৎ আগামীর বাংলাদেশ
এনসিপি একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছে, যার নেতৃত্ব এসেছে ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে। স্বাধীনতার পর নতুন প্রজন্মের দাবি ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এনসিপি একটি ‘নতুন ধারার রাজনীতি’ গড়ে তুলতে চায়। দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র এবং সহিংস রাজনীতিকে পেছনে ফেলে একটি উন্নত, প্রযুক্তিনির্ভর ও তরুণমুখী বাংলাদেশ গড়াই এদের প্রধান লক্ষ্য।
তবে চ্যালেঞ্জও প্রবল। অভিজ্ঞতার ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বাধা এবং নির্বাচনী জোটের অস্থিরতা এনসিপির জন্য বড় পরীক্ষা। তারা যদি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে এবং সংস্কারমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়, তবে এনসিপি আগামীর বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
তবে এনসিপির কাছে জনগণ তথা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক ছিল, সময়ের ব্যবধানে লাগামহীন চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অশালীন বক্তব্য সবকিছু মিলিয়ে এনসিপি জনগণের আস্তা হারিয়ে ফেলেছে অনেকাংশে।
লেখক : নূরুজ্জামান হীরা, উপাধ্যক্ষ ন্যাশনাল পাবলিক কলেজ উত্তরা ও বিজেপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ।
মন্তব্য করুন