শ্রী শ্রী চাঁদানুবেশু হে সিনিয়র, হোয়াটসআপ! জানচাঁপ (জাতীয় নব্য চাঁদাবাজ পরিষদ) বা জুনিয়রের পক্ষ থেকে চাঁদনী রাতের সংগ্রামী শুভেচ্ছা নিবেন। আশা করি চাঁদায় আয়-রোজগারের পাচার করা টাকা দিয়ে আপনার ভালোই পলাতক জীবন পার হচ্ছে। এতদিন ধরে আপনাদের তিল তিল করে গড়ে তোলা চাঁদা শিল্পের সুফল আমরাও ভোগ করতে পেরে গর্বে গর্বিত। সারা দেশে চাঁদার সিন্ডিকেটের জাল বিছিয়ে আপনারা বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। এক সময় ভেবেছিলেন নিজেরা না থাকলে কেই-বা হাল ধরবে। কিন্তু না আমরা আশাহত করিনি। ‘বিকল্প’ হয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে গেছি।
আপনাদের দুরন্ত উজ্জ্বল কীর্তি দেখে প্রায়ই আমার কুশীল কঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো বলতে ইচ্ছে করে- ‘হে বড় ভাই, আপনাকে দিলাম যাত্রাবাড়ি এবং মহাখালী ধোঁয়াচ্ছন্ন বাস টার্মিনালের কসকসে চাঁদার টাটকা নগদ টাকার পকেটভরা হাসির শুভেচ্ছা। বিশেষ করে ডিজিটাল চাঁদাবাজির জাল বিস্তার করে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ। যাহোক, আমাদের মতো নতুন দিনের চাঁদা সৈনিকদের অল্প কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু সফলতা, দুঃখ, উপলব্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আপনাকে জানাচ্ছি। মগজে টুকে নিতে পারেন।
বিগ ব্রো, আগে আপনারা ২০০ টাকা চাঁদা নিতেও হিমশিম খেতেন। আমরা এখন ফুটপাতের টং দোকান থেকেও ৬০০ টাকা সফলভাবে চাঁদা নিয়ে থাকে। আমরা এখন দেশে আইয়ামে চাঁন্দুয়াতের যুগ চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে আমরা চাঁদা তোলাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আগে পুলিশকে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখালেও, এখন আমরা চার গুণ শক্তি সঞ্চয় করেছি। এখন র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর নাকের ডগায়ও দেদারসে চাঁদাবাজি করছি। আগে আপনারা সিক্রেট চাঁদাবাজী করলেও এখন আমরা ওপেন সিক্রেট চাঁদাবাজী করি। কারণ - চাঁদা তুলি গুলিস্তানে, ভাগ যায় গুলশানে। চাঁদা তুলি পাতি নেতা, ভাগ পায় বড় নেতা। চাঁদা তুলি গঞ্জে, ভাগ যায় কেন্দ্রে।
চাঁদার টাকা দিয়ে এ বছর সরকারকে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে তিন লাখ টাকা ট্যাক্সও দিয়েছি। শিগগিরই একটি বৈধ রিভলবার এবং একটি বিদেশি পিস্তল হাতে আসবে। তবেই হবে জোর যার মুল্লুক তার, চাঁদাবাজদের জয় জয় কার। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা সবাইকে সরিয়ে দেশের পুরোদস্তর মালিক বনে যাব। তখন আর বলবো না চাঁদা দাও, তখন বলব ভাড়া দাও। তখন আমাদের নামের সঙ্গে চাঁদাবাজ বিশেষণ আর লেপটে থাকবে না।
ওপেন সিক্রেটলি জানাচ্ছি যে চাঁদা বাগের আশীর্বাদে আমরা ধরা পড়লে দেশের হত্যাকর্তারাও এখন জাতির সামনে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, তোমরা আমাদের সন্তান, ভুল করেছো, আমাদের উচিত তোমাদের ক্ষমা করে দেওয়া। এখন মনের সুখে গাইতে ইচ্ছে করে সেই গাল জয়ী গান - এমন দেশটি এখন চাঁদা বাজিতে ভরা, সকল দেশের শ্রেষ্ঠ চান্দাবাজ মোরা, এটাই মোদের অহংকার।
ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন সামনে রেখে আপনাদের দেখানো পথে চাঁদাবাজি করছি। নগদ টাকার উত্তোলনের পাশাপাশি একটা কিউআর কোড তৈরি করে নিয়েছি, মানুষ এখন সহজেই কিউ আর কোডটি স্ক্যান করে চাঁদা দিতে পারে। এ ছাড়া দ্রæত চাঁদা প্রদানে মানুষকে উৎসাহিত করতে ক্যাশব্যাক অফার চালু করেছি। এইতো আগামী কয়েক দিন পরেই এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘বর্ষসেরা চাঁদা প্রদানকারী’ পুরস্কারটাও হাতে ধরিয়ে দেব।
শীঘ্রই আমরা নিজেদের ব্র্যান্ডিংয়ে মনোযোগ দেব। এতে সহজেই লোকজন দূর থেকেও আমদের চিনতে পারবে এবং চাঁদার টাকা প্রস্তুত রাখবে। আপনাদের থেকে আমরা আরো স্মার্ট কোনো বেশ ধরবো, যা হবে প্রযুক্তির নির্ভর, যেন আমরা আপনাদের মত পলাতক হলেও মানুষ আমাদের চাঁদা দেয়।
এখন আমাদের স্ট্যাটাসেও পরিবর্তনে আসছে। আগে মানুষ আমাদেরকে টোকাই হিসেবে চিনলেও এখন চাঁদার সুফলে আমাদেরকে মাদবর হিসেবে ইজ্জত করে। যদিও পিছনে গালাগাল ও অভিশাপ দেয়। আপনার আশীর্বাদ থাকলে এই শাপে আমাদের কিছু হবে না।
চেষ্টা করতেছি চাঁদা গ্রহণে সর্বদা নিজের পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে। কোনো অবস্থাতেই নিজের ক্যারেক্টার থেকে বের হব না। এমনকি চাঁদাবাজি করার সময় গার্লফ্রেন্ডের সামনে পড়লেও ক্যারেক্টার পরিবর্তন করি না। বরং সুযোগ পেলে তার থেকেও কিছু চাঁদা আদায় করে নিয়েছি। এ বিষয়টি আমি খুব চিন্তা করি যে, একবার পেশাদারিত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্যারেক্টার থেকে বের হয়ে ভালো মানুষ সাজলে পরদিন আর মানুষ আমাকে মূল্য দেবে না, চাঁদা তো দূরের কথা।
চাঁদাবাজি করার সময় অনেকেই মায়াকান্না জুড়ে দিয়ে নিজেকে গরিব দাবি করতে থাকে, চাঁদাদানে অক্ষম প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকে। এ ক্ষেত্রে আপনার বাতলে দেওয়া উনিশশ কুয়াত্তর সালের সেই কথাটি মুখস্ত করে রেখেছি - চাঁদা আমার মৌলিক অধিকার। এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া বাকি সবাই ধনী। এবং আমরা ছাড়া বাকি সবাই কাজ করে খেতে হবে। কোনো রকম ইমোশনাল অ্যাটাকের শিকার হতে বাঁচতে অনেক সময় কানে তুলা দিয়ে থাকি। বেশি কথা বললে শার্টের কলার চেপে ধরি। আমার মনে হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য শার্টের কলার মূলত একটা তারবিহীন সুইচ। ওখানে চেপে ধরলে ভয়ে এটিএম মেশিনের মতো পকেটের টাকা শুরশুরকরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের করে দেয়।
আপনাদের দীর্ঘদিনের এই চাঁদাশিল্পে ইতিপূর্বে আমাদের পদচারণ না থাকায় ভিজ্ঞতার অভাবে চাঁদা তুলতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে আপনাদের যে চাপার জোর ছিল, আমরা এটা এখনো পুরোপুরি অর্জন করতে পারি নাই। আপনাদের মত হাবিজাবি জোরে গালি দেওয়া এখনো শিখতে পারি নাই, এজন্য অনেক সময় দ্রæত চাঁদা হাতে পাই না। গালি প্র্যাকটিসের জন্য মাঝেমধ্যে ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি করা মহানায়কের সিনেমা দেখতে হচ্ছে।
মাঝেমধ্যে চাঁদা তুলতে গেলে লোকজন আমাকে ‘১৭ বছর কোথায় ছিলে?’ বলে তাচ্ছিল্য করে। এসবে আমি ঘাবড়ে যাইনা। সব সময় মনে রাখি, এখন যেমন আপনারা বড় ভায়েরা দৌড়ের ওপর আছেন, তেমনি একদিন আমাকেও দৌড়ের ওপর থাকতে হবে। এ জন্যই আপনি বড় ভাই একবার খই খই করে বলেছিলেন, ‘লাইফ ইজ আ রেস।’ মানুষমাত্রই দৌড়বিদ।
বিগ ব্রো, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই এখন আপনাদের জায়গায় আমরা পুরোদমে কাজ করছি। এতে আপনি মন খারাপ করবেন না। আমাদের পকেট পূর্ণ করার এখনই সময়। যা এক সময় আপনিও করেছেন। আপনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যে পকেটের ‘পূর্ণতা’ নিয়েই তো আর্টসেল গেয়েছে, ‘আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে/তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে।’
আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে এক সরকার যাবে, আর এক সরকার আসবে, কিন্তু মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া যাবে না-এই প্রতিপাদ্যকে মনে লালন করে আমাদের মত চাঁদাশিল্প এগিয়ে যেতে হবে। কোনো পরামর্শ থাকলে এক সেকেন্ড দেরি না করে পই পই বলে দিবেন। তবে আমার মনে হয় আপনারা বেশ কয়েক মাস গর্তে থাকলেও এখন উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছেন। আশা করছি আপনার আশীর্বাদ থাকলে সামনের দিনগুলোয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা চাঁদা শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে পারব।
আশা করি শীঘ্রই চাঁদা কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারব। প্রয়োজনে আইন কানুন বিধি বিধান এমনকি সংবিধান-এর ৪২ ধারা মানে পটেটো বা গোল আলু না, বিয়াল্লিশ ধারা সংযুক্ত করে চাঁদার বৈধতা গ্রহণ করবোই। কর্তৃপক্ষ রাজি না হলে ঘেরাও হলেও করে দাবি আদায় করে ছাড়বো। আশা করি আগামী তিন মাসের মধ্যে চাঁদা শিল্প অতীতের সব রেকর্ড ব্রেক করবে। দোয়া করবেন যাতে চক্ষু লজ্জা আবার না চলে আসে। সব সময় বড় গলায় চাঁদা চাওয়ার হিম্মত যেন থাকে। জনগণ আমাদের কে দয়ালু চাঁদাবাজ হিসেবে জানে এবং মানে। কারণ অতীতে আপনারা এককালীন চাঁদা নিতেন। এখন আমরা স্মার্ট পদ্ধতিতে বা কিস্তিতে চাঁদা আদায় করি।
আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমাদেরকে তাচ্ছিল্য করে বলে আমরা নাকি পরিশ্রম করে খাইনা। চান্দা তোলা কি কম পরিশ্রম ? প্রতিদিন মোবাইলে এবং প্রয়োজনে সামনাসামনি অনেক জোরে ধমক দিতে হয়, এ পর্য্যন্ত ৪২০ বার গলার বকাল কর্ড বা ষড়যন্ত্র ফেটে গেছে। কয়েকবার রক্তক্ষরণ ও হয়েছে। এখন গলায় এমন অবস্থা হয়েছে যে, কিছু বললেই জনগণ মনে করে শুকুর ডাকছে। এতে অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, নতুন কর্কশ কণ্ঠে কথা বললেই মানুষ ভয় পেয়ে চাঁদা দিয়ে দেয়। আপনি আরো জেনে আনন্দিত হবেন যে,আমরা বাংলাদেশে এমন এক চাঁদাবাজির রাজত্ব কায়েম করেছি, এ কারণে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই আপনারা টুস করে ঢুকে যেতে পারবেন।
ব্রো আপনারা ছিলেন শাহী চাঁদাবাজ। আমরা ছ্যাঁচড়া চাঁদাবাজ হওয়ায় জনগণ আপনাদের প্রতি কিছুটা নমনীয়। অনেকে এ কথাও বলে যে আগের চাঁদাবাজটাই ভালো ছিল। আমরা খুব তাড়াতাড়ি চাঁদা শিল্পকে এমন এক পর্য্যায়ে নিয়ে যাব, প্রতিটি গ্রাম-মহল্লা, বাড়ি-ঘর, এমনকি বাদ যাবে না একটি শিশুও।
আশা করি ভবিষ্যতে আমাদের ভাবসাব হবে সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের শেকর অনেক গভীরে চলে যাচ্ছে কিন্তু। এটাতো কেবল ট্রেইলর বললাম। পিকচার আবি বাকি হে। আমরা নবীনদের আকৃষ্ট করতে এখন যৌবন যার চাঁদাবাজির শ্রেষ্ঠ সময় তার এচরনটিও ব্যবহার করে থাকি।
ইতি
সভাপতি, জানচাঁপ (জাতীয় নব্য চাঁদাবাজ পরিষদ)
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
মন্তব্য করুন