মানবতা শব্দটির ব্যুৎপত্তি মানব + তা → সংস্কৃত ‘মানব’ (মানুষ) + ‘তা’ (ভাব)। সমার্থক শব্দ - মানুষত্ব, মনুষ্যত্ব, দয়া, পরোপকার। বিপরীতার্থক শব্দ অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, পশুত্ব, নির্দয়তা। মনুষ্যত্ব বা মানবতা হলো পশুত্বের বিপরীত। মানবতা মানুষের এমন একটি বৈশিষ্ট্য যার দ্বারা একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হতে পারে। মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি, মায়া, মমতা, ভালবাসা প্রদর্শন করাই হচ্ছে মানবতা। অর্থাৎ অন্যের সুখে, দুখে, আনন্দে, বেদনায় কারো মধ্যে একই অনুভূতি কাজ করাকে মানবতা বলা হয়। মানবতা মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে শেখায়। একজন মানুষের মনুষ্যত্ব তখনই শেষ হয়ে যায় যখন সে অন্যকে দুঃখী দেখে নিজে খুশী হতে চায়। সফলতা পেতে গেলে যেমন নিরন্তর পরিশ্রমের প্রয়োজন, তেমনি একটি সুন্দর সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন মানবতা। কারোর কষ্ট দেখে আপনার মন যদি অস্থির হয়ে ওঠে, তাহলে বুঝবেন মানবতা এখনো আপনার মধ্যে বেঁচে আছে। মানুষকে যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, মানবতা আমাদের নামের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে রয়েছে। মানবতা বাদ দিলে মানুষের নামকরণের সার্থকতা থাকে না। মানুষ মানুষই থাকে না। ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে’- এই মানবীয় চেতনা ও মূল্যবোধের মধ্যেই প্রকৃত মনুষ্যত্ব নিহিত। মনুষ্যত্বের জন্যই আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই, বিপদে এগিয়ে আসি। যারা মানুষের জন্য অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, যারা মানুষের কল্যাণে ব্রতী হয়েছেন, যারা মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন সদা সর্বদা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আজ ১৯ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব মানবতা দিবস। বিশ্ব মানবতা দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘বৈশ্বিক সংহতি জোরদার করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়ন করা’। প্রতি বছর সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। মানব সেবায় যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন দিবসটিতে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। জাতিসংঘের মানবিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্রাজিলের কূটনীতিক সেরগিও ভিয়েরা দ মেলো ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট ২১ সহকর্মীকে নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের বাগদাদে গিয়েছিলেন। সেখানে বিরূপ পরিস্থিতিতে বোমা হামলায় তারা নিহত হন। ২০০৮ সালে ১৯ আগস্টকে ‘বিশ্ব মানবতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরের বছর ২০০৯ সাল থেকে দিবসটি পালন শুরু হয়। সৃষ্ট দিবসকে ঘিরে নানা কর্মসূচি এবং কাগজে-কলমে এর সারচিত্র ফুটলে ও বাস্তবে আমরা কতটুকু মানবিক হয়েছি? ফিলিস্তিন সংকট, ইয়েমেন সংকটসহ ৩০টির বেশি দেশে হীনস্বার্থে যুদ্ধ, গণহত্যা করতে গিয়ে মানবিকবোধ যেন ডাইনোসরের বিলুপ্তির মতোই অদৃশ্য হয়ে গেছে!
বিশ্ব মানবতা দিবস আমাদের মানবিক সহায়তার অপরিহার্যতা স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষের মানবতাবোধ জাগ্রত করে। বিশ্ব মানবিকতা দিবসের শিক্ষা প্রধানত মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের উপর ভিত্তি করে। বিশ্বব্যাপী চলমান নানা সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেবা প্রদান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর্থিক শারীরিক মানসিক সমস্যায় তাদেরকে সহযোগিতার শিক্ষা দেয়। সুন্দর, সুশৃঙ্খল সমাজ জীবন গঠনে বিশ্ব মানবিকতা দিবস আমাদের উজ্জীবিত করে। বিশ্বের নানা প্রান্তের সংঘাত, দুর্যোগ, সংকটময় পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। মানবিকতার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। আমাদের উৎসাহিত করে সমতা, ন্যায়বিচার, শৃঙ্খলা এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও এর প্রসারের ব্যাপারেও।
যুগে যুগে এ পৃথিবীর স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তি ও কবি সাহিত্যিকরা, এ মানবতার জয় গান গেয়েই পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করেছেন। দ্রোহ ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে নিপীড়িতের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি কিংবা প্রেম ও মানবতার বাণীতে আজও তিনি সমুজ্জ্বল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘মানবতার কবি’ বলা হয়। তিনি সমাজের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন এবং তার লেখনিতে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতা ও গানে সমাজের অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি ছিলেন বিদ্রোহী, আবার একই সাথে মানবতার জয়গানে মুখর। তার লেখনিতে শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ পায়। নজরুলের সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি কেবল কোনো বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নন, বরং সব মানুষের কবি ছিলেন। তিনি ছিলেন ‘বিদ্রোহের কবি’, ‘প্রেমের কবি’ এবং ‘মানবতার কবি’।
মানবতা নিয়ে বিভিন্ন কবি বিভিন্ন সময়ে কবিতা লিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য্যসহ আরও অনেক কবি মানবতাবাদী কবিতা রচনা করেছেন। তাদের কবিতায় স্থান পেয়েছে মানুষের অধিকার, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। মানবতা নিয়ে লেখা কিছু বিখ্যাত কবিতার মূলভাব নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
মানুষ : এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের জয়গান গেয়েছেন এবং ধর্মের নামে অধর্ম ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছেন এবং সবার প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসার আহ্বান জানিয়েছেন। তোরা মানুষ হবি : এই কবিতায় নজরুল সমাজের অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সাম্যবাদী : এই কবিতায় নজরুল সকল ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার কথা বলেছেন। আমি : এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন এবং মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। হে মোর দুর্ভাগা দেশ : এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশের দুর্দশা ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন এবং তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
ছন্দ : এই কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য্য সমাজের অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন এবং মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই কবিতাগুলো ছাড়াও মানবতা নিয়ে আরও অনেক কবিতা বিভিন্ন কবি লিখেছেন। এই কবিতাগুলো পাঠ করে আমরা মানবতাবোধ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে জানতে পারি।
বিভিন্ন ধর্মে মানবতার ধারণা মূলত একই, তবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম মানবতার কথা বলে। সাধারণভাবে, ধর্মগুলো একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, প্রেম এবং সেবার মাধ্যমে মানবতাকে উৎসাহিত করে। আর ধর্মের অপব্যবহার করেই সবচেয়ে বেশি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়। এখানে কয়েকটি ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো :
ইসলাম : ইসলামে মানবতাকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও ন্যায়বিচার করার কথা বলা হয়েছে।
খ্রিস্ট ধর্ম : খ্রিস্ট ধর্মে, মানবতাকে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন এবং অন্যের প্রতি প্রেম ও সেবার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
হিন্দু ধর্ম : হিন্দু ধর্মে, মানবতাকে ‘ধর্ম’ হিসেবে দেখা হয়, যা প্রকৃতির একটি অংশ এবং প্রতিটি হৃদয়ে বাস করে। এটি পরার্থপরতা ও সেবার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
বৌদ্ধ ধর্ম : বৌদ্ধ ধর্মে, মানবতাকে ‘মৈত্রী’ (বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব) এবং ‘করুণা’ (অন্যের দুঃখ দূর করার ইচ্ছা) দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
ইহুদি ধর্ম : ইহুদি ধর্মে, মানবতাকে ‘জেডেক’ (ন্যায়বিচার) এবং ‘চংবফ’ (প্রেম) এই দুটি ধারণার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
মানবতাবাদী ধর্ম : এই ধর্মটি (Religion of Humanity) অগাস্ট কমতে তৈরি করে, যেখানে ঈশ্বরের পরিবর্তে মানবতার পূজা করা হয়। বিভিন্ন ধর্মের এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হলো, মানবতা মানে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সম্মান এবং সেবার মাধ্যমে একটি উন্নত সমাজ ও বিশ্ব গঠন করা।
বিশ্ব মানবতা দিবস ২০২৫-এ প্রত্যাশা করি- ধর্ম হোক মানবতার, মানব হত্যার নয়’, ধর্ম হোক মুক্তির, বেড়াজালের নয়, ধর্ম হবে না শোষকের হাতিয়ার, ধর্ম হবে শোষিতের অধিকার, ধর্ম হবে না হিংসা-বিদ্বেষের আধার, ধর্ম হবে মানব প্রেমের অঙ্গীকার, ধর্ম থামিয়ে দিক নিপীড়িতের ক্রন্দন, ধর্ম হোক তোমার-আমার ভালোবাসার বন্ধন, তাই মানবতা হোক আমাদের রক্ষাবর্ম, মানবতাকে হৃদয়ে লালন করে, মানুষে মানুষে মৈত্রী গড়ে, এসো গড়ে তুলি নতুন সমাজ, এসো হাতে হাত রেখে, নতুনভাবে নিজেদের গড়ে তুলি আজ। ধর্ম হোক মানবতার।
মানবতা নিয়ে জগদ্বিখ্যাত মনীষীদের কিছু কালজয়ী উক্তি নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
হজরত মুহাম্মদ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না। জালাল উদ্দিন রুমি বলেন, হিন্দু মরলে যে কাঁদে সে হিন্দু। মুসলমান মরলে যে কাঁদে সে মুসলিম। উভয় মরলে যে কাঁদে সে মানুষ। কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন হে, কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র । সৈয়দ শামসুল হক : তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - সঙ্গের দিক থেকে আজকাল হিন্দু-মুসলমান পৃথক হয়ে গিয়ে সাম্প্রদায়িক অনৈক্যকে বাড়িয়ে তুলেছে, মনুষ্যত্বের মিলটাকে দিয়েছে চাপা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মানুষের সেবা করা হচ্ছে ঈশ্বরের সেবা করা। স্বামী বিবেকানন্দ : মানবতাই মানুষের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত। বার্নার্ড রাসেল : আমাদের ধর্ম হোক ভালোবাসা আর জাত হোক শুধু মানবতা। তবেই আমরা জয়ী হবো। কবি শামসুর রাহমান : একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের (পিছিয়ে পড়া) দেশে মানুষ সবচেয়ে বেশি অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে- মাদকসহ ক্ষতিকর নেশা, নারী নির্যাতন, ইভটিজিং ও যৌতুকের করাল গ্রাসে। বিশ্ব মানবতা দিবসের এই দিনে, বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট মোকাবিলায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সুরক্ষার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
তাই বাঙালি কবি কামিনী রায়ের কথায় সে শাশ্বত অনুভূতি ব্যক্ত করে এ নিবন্ধের সমাপ্তি টানছি - ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক এবং প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
মন্তব্য করুন