তোফাজ্জেল ইসলাম
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০২:১৬ পিএম
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৫৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বৈষম্যহীন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য যা প্রয়োজন

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

একজন বিশ্বনন্দিত নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ। এটি ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি। এমতাবস্থায়, প্রত্যাশিত বৈষম্যমুক্ত মেরিটোক্রেসি এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে সবার অঙ্গীকার এবং সর্বোচ্চ চেষ্টার বিকল্প নেই। এটি জাতির জন্য এক মহাসুযোগ হলেও তা খুবই চ্যালেঞ্জিং। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সম্মুখসারিতে জীবনবাজি রেখে অংশগ্রহণ পরবর্তীকালে অভ্যুত্থানের প্রত্যয় বাস্তবায়নে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। হতাশ হয়েছি। এবার নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে মৌলিক সংস্কার সাধন এবং সব দুর্নীতির বিচার করতে না পারলে আমরা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণে আবারও হতাশ হবো। আমি যেহেতু একজন শিক্ষক এবং গবেষণার ছাত্র, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার কিছু মতামত শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করছি।

আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন চর্চা করতে পারলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ সব পর্ষদে নিয়োগে বৈষম্যহীন ব্যবস্থা করতে পারব না কেন? আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিক প্রভাবমুক্ত মেরিটোক্রেসির চর্চা সর্বাগ্রে শুরু করা আশু প্রয়োজন। মেধাবীকে বঞ্চিত করে অর্থ বা রাজনৈতিক বিবেচনায় যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে তা তদন্ত করে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমি নিজে বাকৃবিতে সব অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে কৃষি অনুষদে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ৪ বার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে ক্রমশ মেধাবীকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ফলশ্রুতিতে, বিশ্বের ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থান পায়নি। সব স্তরে মেধাহীনদের দৌরাত্ম্য আমাদের এ রকম লজ্জাকর অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করে ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্ব তৈরিতে নানা রকম ক্লাব অ্যাক্টিভিটি, ইন্টার্নশিপ এবং অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগে সমস্যা সমাধান ও সম্পদ তৈরিতে উদ্যোক্তা হিসেবে বিকাশের পরিবেশ এবং সুযোগ তৈরি করতে হবে।

গত ১৪ বছরকাল বশেমুরকৃবিতে আমার অভিজ্ঞতা এবং প্রায় এক যুগব্যাপী জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের টপ র‌্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা এবং গবেষণায় নিবিড় কর্ম অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই সংস্কার শুরু করে সংস্কারের প্রত্যয় দৃশ্যমান করতে পারে। এ কাজ স্বল্প সময়ের মধ্যেই করা যেতে পারে। জনমনে আস্থার জন্য দৃশ্যমান সংস্কার আশু দেখাতে হবে, যা আমাদের মনোসংযোগ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলবে এবং এ সংস্কার কর্মকাণ্ডে জাতিকে আত্মবিশ্বাসী করবে।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, ৫ আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানের পর পরই প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারারসহ প্রশাসনিক পদে যারা ছিলেন তারা পদত্যাগ করেছেন কিংবা পালিয়ে আত্মগোপনে আছেন। কেন এমনটি হচ্ছে? প্রাণ ভয়ে?

যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজমান প্রশাসনিক শূন্যতা আশু পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান প্রয়োজন। দ্রুত এ শূন্যতা পূরণে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষক (দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত) এবং গবেষকদের সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যেই সরকারকে সুপারিশ প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের শিক্ষা, গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃজন, জ্ঞানের চর্চা এবং জ্ঞানের অনুবাদের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম করার উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যথাযথ সংস্কার করতে সক্ষম হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আশু বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম। এক যুগের বেশি সময়কাল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং জার্মানির টপ র‌্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা এবং গবেষণা অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, মেধা ও মননে আমাদের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী বিশ্বমানের।

আমি মনে করি, The University for the Students. সুতরাং দক্ষ, সমালোচনামূলক চিন্তাবিদ (critical thinkers), উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা গ্র্যাজুয়েট তৈরির জন্য বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করে বিশ্বমানে উন্নীত করতে একটি কমিশন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সব অংশীজন বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা আবশ্যক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন চর্চার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্ষদে (সিন্ডিকেটে) রাজনীতিবিদ তথা সংসদ সদস্যের অন্তর্ভুক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি চর্চার মূল কারণ ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং সর্বোচ্চ পর্ষদে (সিন্ডিকেটে) দলীয় রাজনীতিবিদ নিয়োগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব নিয়োগে মেধা এবং যোগ্যতা বিবেচ্য হয়নি। এমনকি বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের কথাও শোনা যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি মহাজমিদারের মতো আচরণ করে আসছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন আশু প্রয়োজন নয় কি? কঠিন হলেও এক্ষেত্রে সংস্কার করা না হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের শিক্ষা এবং জ্ঞানের আধারে উন্নীত করা যাবে না।

আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে স্বতন্ত্র আইন, যা দ্রুত সংস্কারে অন্তরায় হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার একটি সাধারণ অর্ডিন্যান্স দ্বারা সিন্ডিকেটের গঠনসহ অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন আনয়ন করতে পারে, যেন একজন ভিসি কখনো দলদাস একনায়কে পরিণত হতে না পারে। এক্ষেত্রে সব পর্ষদে ছাত্রছাত্রীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যেতে পারে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান কেবল প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করেছে। হিমালয় পর্বতসম উচ্চ জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা খুবই চ্যালেন্জিং। আমি আবারও বলছি, ছাত্র অভ্যুত্থানের সূতিকাগার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সুদূরপ্রসারী মৌলিক সংস্কার শুরু করা যেতে পারে। সংস্কারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠিত সব ধরনের দুর্নীতির স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধের সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কারের পাশাপাশি ধাপে ধাপে শিক্ষার সব স্তরেই সংস্কার আবশ্যক। অন্যথায় আমরা সত্যিকারের শিক্ষিত সুনাগরিক তৈরি করতে ব্যর্থ হবো।

এবারের ছাত্র অভ্যুত্থানে যদি জনআকাংক্ষা পূরণে আমরা ব্যর্থ হই, সে ব্যর্থতা হবে সমগ্র বাঙালির, সমগ্র বাংলাদেশের। সেজন্য জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের মাতৃভূমির মঙ্গলের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এটাই যেন হয় আমাদের শেষ রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ।

তোফাজ্জেল ইসলাম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই)-এর পরিচালক, অধ্যাপক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২০ বছরের ব্যবসা বাঁচাতে ছাড়লেন চেয়ারম্যান পদ

তাসনিম অনন্যার অনুসন্ধানে মহাবিশ্বের চাঞ্চল্যকর রহস্য উন্মোচন

২০২৬ বিশ্বকাপে কবে মুখোমুখি হতে পারে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল?

বিশ্বকাপের গ্রুপ অব ডেথে ফ্রান্স

নুরুদ্দিন অপুর হাত ধরে আ.লীগ নেতার বিএনপিতে যোগদান

২০২৬ বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠিত: দেখে নিন কোন গ্রুপে কোন দল

২০২৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ যারা

রাতে আবার হাসপাতালে গেলেন জুবাইদা রহমান

যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়ছে, তালিকায় ৩০টির বেশি দেশ

খালেদা জিয়ার এন্ডোসকপি সম্পন্ন, বন্ধ হয়েছে রক্তক্ষরণ

১০

‘বাঁধের মাটি বড় বড় খণ্ড হয়ে ঝুপঝাপ শব্দে ভেঙে পড়ে’

১১

রাজমিস্ত্রির বাড়ি থেকে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার

১২

দেড় হাজার দৌড়বিদের অংশগ্রহণে হাফ ম্যারাথন

১৩

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় ফ্রি যাত্রীসেবা

১৪

বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা, প্রতিবাদে বিক্ষোভ 

১৫

যুবদল নেতা সুমনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

১৬

দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ১০

১৭

গণতন্ত্র মঞ্চের নতুন সমন্বয়ক সাইফুল হক

১৮

পুরোনো রাজনীতি পরিহার করে নতুন রাজনীতি করতে চাই : মঞ্জু

১৯

খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা দেখার জন্য শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন : স্বপন

২০
X