বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায়। আর মাত্র কয়েকটি মাস। আমরা আগে দেখেছি, জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস বাকি থাকতেই মানুষের মধ্যে বিপুল উত্তেজনা বিরাজ করতে। কিন্তু হায়! আজ সেই উত্তেজনা অনেকটাই স্তিমিত। আমরা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দুটি উপনির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি খুব কম দেখেছি। এটি নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো প্রকার দায়ভার কেউই নিতে চাইছেন না। আমি নিশ্চিতভাবে ভোটারদের কথা বলছি না; দায়টা তাদের নয়; দায়টা তাদের যারা এই নির্বাচন আয়োজন ও পরিচালনা করেন। নির্বাচন মোটা দাগে হলো- একটি বন্দোবস্ত যার মাধ্যমে ভোটার তার পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। কিন্তু আমরা দেখেছি, একপেশে নির্বাচন, যার নির্ণায়ক হচ্ছে ১০-১২ শতাংশ ভোট! এই যদি হয় আমাদের গণতন্ত্র; তাহলে আগামী নির্বাচন কী হবে; সেটা খুব বেশি না ভেবেই একপ্রকার বলে দেওয়া যায়।
যাই হোক; আমার এ পর্বে আমি উল্লেখ করেছি- ফ্যাকাসে গণতন্ত্র; যা প্রায় ম্রিয়মাণ। সাদামাটাভাবে যদি একটু চিন্তা করি- গণতন্ত্র কী? প্রথমেই আসে- রাষ্ট্র মৌলিকভাবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হবে; যেখানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে, বাকস্বাধীনতা থাকবে, মুক্ত চিন্তাধারা থাকবে, আইনের শাসন থাকবে। এখন কী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কি দ্বিমত পোষণ করতে পারে? সামাজিক গণমাধ্যমে কি আমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখছি? মাথার ওপরে ঝুলে আছে- সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো খড়গ!
ধরা যাক, কোনো একটি ক্লাসে একজন শিক্ষার্থীকে প্রস্তাব করা হলো- তোমাকে আগামী বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হবে; কিন্তু একটা শর্ত আছে- কী সেটা? তুমি প্রথম স্থান অধিকার করবে; কিন্তু তোমাকে ওই ক্লাসেই আরেকবার থাকতে হবে! সবাই জানবে তুমি প্রথম হয়েছ; সুতরাং তোমার নিজের উন্নয়ন হয়েছে; উন্নতি হয়নি! তুমি মানুষকে বলতে পারবে- তুমি মেধাবী, তুমি অধ্যবসায়ী; কিন্তু সেটা একটা মাকাল ফল!
আমাদের দেশের সরকার এখন ‘উন্নয়নে’ বেশি আগ্রহী; উন্নতিতে নয়। যে উন্নয়ন আমাদের দেখানো হয়েছে- সেটা দেখতে এবং দেখাতে খুবই আড়ম্বরপূর্ণ, চাকচিক্যে জর্জরিত; কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। সেটাতে উন্নতি হয়নি! কেন? কারণ; যে ঋণের বোঝা জাতির ওপরে চাপানো হয়েছে; তাকে উন্নতি বলা যাবে না। প্রাথমিকভাবে খাতওয়ারি হিসেবে দেখলে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে এই খাতগুলোতে ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে? বিদ্যুৎ খাতে এখনও লোডশেডিং; যোগাযোগ খাতে একটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের ৩-৪ গুণ সময়ে শেষ করা হচ্ছে; আবার সেই সঙ্গে ব্যয় বৃদ্ধি, প্রকল্পের নকশা ত্রুটিপূর্ণ হলে আবার নতুন করে প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হচ্ছে। করোনাকালীন স্বাস্থ্য খাতে ভয়াবহ অবস্থা দেখেছি। অক্সিজেন সংকট দেখেছি। এখন দেখছি ডেঙ্গু নিয়ে মানুষের কী হয়রানি! তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে খুব শুনেছি ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের কথা; কিন্তু বাস্তবে দেখি- আজকাল খুব অহরহ হ্যাকিং চলছে! বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকে শুরু করে এনআইডি সার্ভার; অর্থাৎ দেশের আর্থিক খাত থেকে ব্যক্তিগত তথ্য, কোনোটিই আর নিরাপদ নয়।
বাংলাদেশ এখনও অনুন্নত দেশের তালিকায় আছে- দক্ষিণ-এশিয়া থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে শ্রীলঙ্কা, ভুটান, আফগানিস্তান, বার্মা ও নেপাল। বাংলাদেশ ১ পয়েন্ট নিয়ে ভুটানের ওপরে আছে। তাহলে আমাদের কী বোঝানো হচ্ছে? বড় বড় অবকাঠামো দিয়ে মানুষকে বোঝানো হচ্ছে- আমার এখন মধ্যম আয়ের দেশ! যে দেশে নতুন করে ২ কোটির মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। আমরা দেখলাম সংসদে বিদ্যুৎ নিয়ে কি তামাশা- বিদ্যুৎ নাকি ফেরি করে বেড়াতে হবে! বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে জ্বালানি কিনতে পারছে না সরকার। একটু আগে যে ছাত্রের উদাহরণ দিলাম, এখন সেটাই হয়েছে আমাদের নিয়তি! আমাদের শুনতে হয়েছে- বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে, সব থেকে সুখী বাংলাদেশের মানুষ! যিনি বলেছেন- তিনি নিজেই উন্নত বিশ্বের একটি দেশের নাগরিক। সুতরাং; অনেক উন্নয়ন হয়েছে; কিন্তু এই প্রকাণ্ড ঋণের দৈত্য আমাদের ঘাড়ে, যা নিয়ে ঘাড় উল্টিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
যে কোনো দেশেই যদি যারা ক্ষমতাধর, ইংরেজিতে যাদের বলে- ক্লেপ্টক্র্যাট (kleptocrat); যখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যায়; সেখানে কোনো আইনের শাসন থাকতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যারা উন্নতি করেছে অথচ আইনের শাসন অনুপস্থিত। আইন যদি প্রয়োগ করা হয় শুধু ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, সেটি গণতন্ত্র নয়ই; বরং বেআইন বললে বাতুলতা হবে না। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে; আমরা ভোট দিতে চাই নাকি উন্নয়ন চাই? আমরা মুক্ত চিন্তা চাই; নাকি বুলি আওড়াতে চাই?
পরিশেষে কোনো জাতীয় নির্বাচন সময়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে প্রথমবারের মতো পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রসমূহ দাঁড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, তাদের স্বার্থ আছে; কিন্তু সেটা যদি বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের অসহায় মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়ে থাকে; অবশ্যই সেটা মঙ্গলজনক হবে। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে বাণিজ্য সূচকগুলো একটু বিশ্লেষণ করলেই বোধগম্য হয়ে যায়; কারা সত্যিকার অর্থে আমাদের সহযোগী ও বিশ্বস্ত বন্ধুরাষ্ট্র। কায়মনোবাক্যে আশা করছি, আগামী দিনের ভবিতব্য হোক একটি স্নিগ্ধ ও স্বর্ণালি বাংলাদেশ।
মন্তব্য করুন