১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনের হত্যাযজ্ঞ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের একটি নিষ্ঠুরতম, নৃশংসতম বিভীষিকাময় ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। ১৫ আগস্টের সূর্য ওঠার আগেই স্বাধীনতার শত্রুরা জাতির জনক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে।
১৫ আগস্টের এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন হারিয়েছি একজন মহান নেতাকে, অবসান হয়েছে একটি সংগ্রামী জীবনের তেমনি অন্যদিকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দেশের অর্থনীতিকে। স্বাধীনতার পর দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু দেখতে পেলেন পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের ঘরবাড়ি, স্কুলঘর, হাট বাজার গুলো জ্বালিয়ে দেয়। পুড়িয়ে ফেলে ব্যাংকের টাকা এবং শূন্য করে ফেলে সরকারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল, পুড়িয়ে দেয় খাদ্য গুদাম, ভেঙে ফেলে কৃষি ব্যবস্থা, ধবংস করে দেয় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। দেশের এই অর্থনৈতিক দুরব্যবস্থায় দায়িত্ব গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু নজর দেন দেশ পুনর্গঠনের কাজে।
অর্থনীতিকে একটি সুষ্ঠু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা।
তবে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু খুব সুস্পষ্ট ভাবেই বলেছিলেন ‘বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না, তা যারা করেছেন, তারা কোনোদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেন নাই। কারন লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না- যেমন আন্দোলন হয় না। সে জন্য দেশের পরিবেশ, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের কাস্মট, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব সবকিছু দেখে স্টেপ বাই স্টেপ, এগিয়ে যেতে হয়।
একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্য পর্যালোচনায় লক্ষণীয় হয়, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি শোষণহীন সমাজ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন।
বিশ্বব্যাপী বিরাজমান সমাজতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে মুনাফা নয়, ব্যবহার বা ভোগের উদ্দেশ্যে উৎপাদন। এই বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতি রেখে উৎপাদনের ওপর বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দিয়েছিলেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। প্রতিটি রাজনৈতিক সমাবেশসহ ছাত্রসমাজ, পুলিশ সামরিক বাহিনী, সাংসদ, জনগণ প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য পেশ করেছেন।
১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ৮০ ভাগের মালিক আপনারা। এখন উৎপাদন বাড়িয়ে সকলে মিলে কাজ করে একথাটাই বিশ্বের কাছে প্রমান করতে হবে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার পবিত্র আমানত রক্ষার উপযুক্ত।’ ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘এই বাংলায় সম্পদের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তার সদ্ব্যবহারের জন্য সময়ের প্রয়োজন। আমরা যদি বাংলার এ সম্পদ বাংলার মাটিতে রাখতে পারি সমাজতান্ত্রিক বিলিবণ্টন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারি এবং সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে কল-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বাড়াতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ আমাদের ভাবি বংশধরদের শোষণমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধশালী এক ভবিষ্যৎ উপহার দিতে পারব।’
১১ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে কুমিল্লার সামরিক একাডেমিতে শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের। তোমরা পেশাদার বাহিনী নও, কেবল সামরিক বাহিনীও নও। দরকার হলে তোমাদের আপন হাতে উৎপাদন করে খেয়ে বাঁচতে হবে।’
১৯ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মাঠে কলকারখানায় সর্বত্র আমাদের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে।’
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সংবিধান সংশোধনীর ওপর আলোচনায় পাঁচবার উৎপাদন, বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন, বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশ বাঁচতে পারে না। আরেকবার বলেছেন ‘ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে হবে। কোনো জমি পড়ে থাকতে পারবে না। তোমাদের উৎপাদন, বাড়াতে হবে।’
একদিকে যেমন উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি সেই উৎপাদিত পণ্য যেন ব্যবসায়ির অধিক মুনাফা আহরণের হাতিয়ার না হয় সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দেশের দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি কালোবাজারিদের সাথে সমভাবে অভিযুক্ত করেছেন মুনাফাখোরদের। তিনি বলেছেন, ‘... যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশ চোরাচালানদেয়-তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।’
মুনাফাখোরদের উদ্দেশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তার পাশাপাশি পণ্যের সুষ্ঠু এবং সুষম বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন পদক্ষেপ। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৯৭২ সালে ১৯ মে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৪৭-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বাংলাদেশ কনজুমার সাপ্লাইজ করপোরেশন (COSCOR) যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ন্যায্যমূলের দোকানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা।
এ ছাড়াও ১৯৭২ সালের ১৪ জুন ৬৮ নং রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ট্রেডং করপোরেশন অব বাংলাদেশ। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আনীত দ্রব্যসামগ্রী সরকারে নিযুক্ত ডিলার, এজেন্ট এবং অন্যান্য দোকানের মাধ্যমে বিতরণ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সরকারের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া নির্দেশ অনুসরণ করে বিভিন্ন দ্রব্য ন্যায্যমূল্যে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পণ্য সরবরাহে ঘাটতি বুঝে কতিপয় ব্যবসায়ীর অতিমুনাফা আহরণের প্রচেষ্টা পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং মূল্যস্তর সাধারন নাগরিকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় যা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সাথে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বিধায় ৫ এপ্রিল ১৯৭২ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমাদের আমি ব্যবসা করতে দিয়েছিলাম, কিন্তু বাংলার মানুষকে আমি লুট করতে দেই নাই। তোমাদের আমি বলে দিচ্ছি যদি জিনিস পাওয়া যায় তবে কেন জিনিসের দাম বেশি হবে?’
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য খুব স্পষ্টভাবেই প্রমাণ দেয় বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন ভোক্তার কাছে পণ্যের মূল্য পণ্যের চাহিদা এবং জোগানের ভিত্তিতে নয় উৎপাদন ব্যয়ের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে যেটি পুজিবাদি এবং সমাজতান্ত্রীক অর্থ ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য। পণ্যের চাহিদা এবং জোগানের ভারসাম্যহীনতার কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই সমাজতান্ত্রীক অর্থব্যবস্থায়।
বর্তমান বাজার অর্থনীতির কবলে পড়ে জনগনকে যে পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে প্রায় প্রতিনিয়ত। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির এই মূলনীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব প্রদানের ফলে কৃষি, শিল্পসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল উল্লেখযোগ্য হারে। শিল্পে বঙ্গবন্ধুর শাষণামলের সাড়ে তিন বছরে গড় বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশের ওপরে, যা ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা।
কৃষি ক্ষেত্রেও উৎপাদনের বৃদ্ধি ছিল উল্লেখ যোগ্য। এ ছাড়া পণ্যের সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করনে গৃহীত পদক্ষেপের কারনে দ্রব্যমূল্য সূচক ৪০৭.৫৮ থেকে নেমে এসেছিল ৩৮০.১৪-তে। সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিমাপক জিডিপি বা জাতীয় আয় ১৯৭৩-৭৪ সালের চলতি বাজার মূল্য ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা ১৯৭৪-৭৫ সালে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। সহজ কথায় বলতে গেলে, দেশ বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল, ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাত সে স্বপ্ন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
এক কথায় বলতে গেলে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে ঘাতকরা শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করেনি, তারা স্তব্ধ করে দিয়েছিল দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে।
মো. শাহাদাৎ হোসেন : এফসিএ, সাবেক সভাপতি, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনন্ট্যন্টস অব বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন