বাংলাদেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণ এখন একটি ভয়াবহ পরিবেশ সংকটে পরিণত হয়েছে। ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও বাস্তবে সেই আইন কার্যকর হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নিষিদ্ধ বস্তু আবারও দৈনন্দিন জীবনে স্থান করে নিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ এখনো পলিথিন ব্যবহার করছে এবং প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে প্রায় দুই কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ, যার সিংহভাগই শেষমেশ নদী-নালা, খাল-বিল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে জমছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮.৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়। ২০০৫ সালে যেখানে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ছিল ৩ কেজি, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ কেজিতে; ঢাকায় এ হার প্রায় ২৪ কেজি। নগরের প্রায় ২০ শতাংশ বর্জ্য প্লাস্টিক, যার ৮০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য। পুনর্ব্যবহার না হওয়ায় এই প্লাস্টিক শেষমেশ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মাটির উর্বরতা কমে, কৃষিজমি বিষাক্ত হয় এবং খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর নিচে এখন জমে আছে ৫ থেকে ৭ ফুট পুরু পলিথিনের স্তর। এই স্তর সরানোর মতো কোনো যন্ত্র বা কার্যকর উদ্যোগ সরকারের হাতে নেই। ফলে পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে, নদী হয়ে উঠেছে মৃত জলাশয়। শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, দেশের অন্যান্য নদী যেমন ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, কর্ণফুলী, কাপ্তাই, ও সুতাং নদীতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। নদীর পানি, কাদা, মাছ, এমনকি ধানেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। রান্নার পরও এসব কণা খাবারে থেকে যাচ্ছে এবং সরাসরি মানবদেহে প্রবেশ করছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো এখন কেবল খাবার নয়, ইনজেকশন ও স্যালাইনের মাধ্যমেও মানুষের শরীরে ঢুকছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ব্যাগ স্যালাইনে হাজার হাজার প্লাস্টিক কণা রয়েছে, যা চিকিৎসার নামে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এই কণা শরীরের কোষের ক্ষতি, প্রদাহ, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, স্ট্রোক ও হৃদরোগের মতো জটিল সমস্যার সৃষ্টি করছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে ধান, গম ও ভুট্টার উৎপাদন কমছে, মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষকরা একে জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই ভয়াবহ বলে মনে করছেন। প্রতি বছর লক্ষাধিক সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণে মারা যায় এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বেশি হবে। বাংলাদেশ থেকেও প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে।
সরকার এ অবস্থার পরিবর্তনে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে একাধিক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে- একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ, পাটের ব্যাগের উৎপাদন বাড়ানো, বইমেলা ও বিপিএলকে ‘জিরো ওয়েস্ট’ করার উদ্যোগ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্লাস্টিকমুক্ত ক্যাম্পাস গড়া, সার্কুলার ইকোনমি প্রকল্প, নারী বর্জ্যকর্মী প্রশিক্ষণ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা- সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত কৌশল তৈরি হচ্ছে।এ ছাড়া কামরাঙ্গীরচরে ১০০ টন নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করে ৩টি কারখানা সিলগালা করা হয়েছে, গাজীপুরে ট্রাক থেকে ১২ হাজার ২০০ কেজি পলিথিন ধরা পড়েছে।
তবে সরকারের এই উদ্যোগ পথে বাধাও কম, এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পলিথিন কারখানায় অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন।
সরকারের বিভিন্ন প্রোগ্রামে প্লাস্টিকের পানির বোতল নিষিদ্ধ করার পর কাচের জগ ও গ্লাসে পানি দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সেখানে পানির সুষ্ঠু সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় বোতল পানি কিনে ওই জগ ও গ্লাস ভর্তি করা হচ্ছে, যা প্রকৃত সমস্যা দূর করতে পারেনি।
আইন থাকলেও তা কার্যকর না হওয়ার কারণের মধ্যে রয়েছে- মনিটরিংয়ের অভাব, স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপ এবং সীমিত জনবল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল আইন দিয়ে কাজ হবে না; প্রয়োজন বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা ও জনসচেতনতা। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু অর্থ ঢেলে এই সংকট কাটানো যাবে না।
সরকার এখন জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। তবে প্রশ্ন থাকে, প্রতিদিন আনুমানিক দুই কোটি পলিথিন তৈরি হচ্ছে, যার প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এই বিপুলসংখ্যক পলিথিন ব্যবহারের সমস্যা কি শুধু জনসচেতনতার ওপর নির্ভর করে সমাধান হবে? কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবেশবান্ধব অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কতদিন লাগবে, তা জানা নেই। ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি বনাম প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যে যে আনুপাতিক দূরত্ব আছে, তা আশার আলো কতটুকু দেখায়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাধারণ মানুষ পরিবেশ নিয়ে সচেতন নয়; কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অবগত এবং দায়িত্বশীল; ২০০২ সালে প্রণীত পলিথিন নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো কার্যকরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না।
সরকার জানিয়েছে, পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহারে কঠোরতা আনা হবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ভর্তুকিমূল্যে পাটের ব্যাগ বিতরণ করা হবে। কিন্তু দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ গবেষক কচুরিপানা থেকে পরিবেশবান্ধব পলিথিন তৈরি করেছেন, যা মাটিতে সহজেই পচে যায় এবং পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে না; কিন্তু তহবিলের অভাবে তা বাণিজ্যিক পর্যায়ে যেতে পারেনি।
রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেক কারখানায় ভুট্টার স্টার্চ ও চুন দিয়ে পচনশীল শপিং ব্যাগ তৈরি হচ্ছে, যা পলিথিনের পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ ব্যাগ উৎপাদিত হয়ে দেশি ও বিদেশি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, সরকারি সহায়তা পেলে ৩-৬ মাসের মধ্যে এই ব্যাগগুলো পলিথিনের কার্যকর বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তবে কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনা হওয়ায় খরচ বেড়ে যায়, তাই দেশেই কাঁচামাল উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া বাংলাদেশে মানসম্মত ল্যাবরেটরি না থাকায় এসব ব্যাগ শতভাগ পরিবেশবান্ধব কি না, তা প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস- এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করো’। বাংলাদেশের বাস্তবতা বলছে, এটি এখন আর কেবল সচেতনতার বিষয় নয়, এটি একটি জীবন-মরণ ইস্যু। পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা- সবকিছুই এ সংকটের সঙ্গে জড়িত। ফলে প্রয়োজন সরকারের নীতিগত কঠোরতা, বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সর্বোপরি নাগরিক দায়িত্ববোধ।
লেখক : মোনছেফা তৃপ্তি, সংগঠক ও পরিবেশকর্মী
মন্তব্য করুন