মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
এ এইচ এম ফারুক
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৪ পিএম
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
গভীর সংকটের অশনিসংকেত

আরাকান আর্মির ‘মাদক সন্ত্রাসে’র কবলে বাংলাদেশ

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত ও ক্ষমতার পটপরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ সংঘাতের আড়ালে যে ভয়াবহ ‘মাদক সন্ত্রাস’ দানা বেঁধেছে, তা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাখাইনের প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এখন তাদের সামরিক ব্যয় মেটাতে পুরোদস্তুর ঝুঁকেছে মাদক বাণিজ্যের দিকে। আর তাদের এ মাদক সাম্রাজ্যের প্রধান টার্গেট ও বাজার হয়ে উঠেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মির মাদক অর্থনীতি যদি এখনই কঠোরহস্তে দমন করা না যায়, তবে আগামী এক দশকে বাংলাদেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত এক দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

যুদ্ধের রসদ যখন ‘মাদক’

২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মি বর্তমানে মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী নন-স্টেট অ্যাক্টর। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিপুল অর্থের জোগান। আর এ অর্থের প্রধান উৎস— মাদক।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আরাকান আর্মি সরাসরি মাদক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও, তারা একটি সুসংগঠিত ‘ট্যাক্সিং’ বা কর ব্যবস্থা চালু করেছে। মিয়ানমারের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল ও শান রাজ্য থেকে আসা ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ (আইস) পাচারের রুটগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের হাতে। মাদক সিন্ডিকেটগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিনিময়ে এবং ল্যাবগুলো থেকে তারা মোটা অঙ্কের ‘সুরক্ষা কর’ আদায় করে। এটি তাদের জন্য একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি— একদিকে আয় বাড়ছে, অন্যদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেটগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে।

টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন : অরক্ষিত রুট ও নতুন কৌশল

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমান্তের দুর্বলতাগুলো আরাকান আর্মির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকনাফ-কক্সবাজার রুট এখন ইয়াবার প্রধান ‘গেটওয়ে’ হিসেবে পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী মাদক পাচারে তারা প্রধানত তিনটি পথ ব্যবহার করছে।

১. নাফ নদী ও জলসীমা। ২. টেকনাফ-হ্নীলা-হোয়াইক্যং-এর পাহাড়ি রুট। ৩. সেন্টমার্টিন ও চট্টগ্রাম উপকূলঘেঁষা মেরিন রুট।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে এখন ‘লজিস্টিক হাব’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্যাম্পের দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং মিয়ানমারে ফেরার অনিশ্চয়তাকে পুঁজি করে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের মাদক পরিবহনে বা ‘বাহক’ হিসেবে ব্যবহার করছে।

ইয়াবার পর এবার ‘ক্রিস্টাল আইস’ বা মেথ

মাত্র ইয়াবায় সীমাবদ্ধ নেই আরাকান আর্মির মাদকবাণিজ্য। এখন তারা উচ্চমাত্রার বিশুদ্ধ এবং ব্যয়বহুল মাদক ‘ক্রিস্টাল আইস’ বা মেথ ও লিকুইড ড্রাগ বাংলাদেশে পুশ করছে। তাদের কাছে ইয়াবার চেয়ে বহুগুণ লাভজনক এই মাদক দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই ‘প্রোডাক্ট আপগ্রেডেশন’ আরাকান আর্মিকে আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্তে।

উদ্ধারের সামান্য নমুনা

মাদকের অন্যতম রুট কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চল। সেখানে নিয়োজিত আছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) টেকনাফ ব্যাটালিয়ন। এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ২১৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ১৪৯ দশমিক ৯৩৩৮ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস জব্দ করা হয়েছে। যার মূল্য মোট ১ হাজার ৮২৬ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ১০০ টাকা। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২ হাজার ৭৫৫টি এবং আসামি ১ হাজার ৯৭৫ জন।

বাংলাদেশের ওপর বহুমুখী বিপর্যয়ের আশঙ্কা

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মির এ মাদক সন্ত্রাস বাংলাদেশের ওপর চারটি প্রধান নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

১. সামাজিক ও জনস্বাস্থ্য : দেশের বিশাল যুবগোষ্ঠী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, যা ভবিষ্যৎ মানবসম্পদকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা, চুরি, ছিনতাই ও খুনের মতো অপরাধ।

২. অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ : মাদক কেনার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বা ক্যাপিটাল মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে কালো টাকার বিশাল অর্থনীতি, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।

৩. জাতীয় নিরাপত্তা ও ক্রাইম-টেরর নেক্সাস : মাদক বিক্রির টাকায় আরাকান আর্মি অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনছে। সীমান্তে তাদের শক্তি বৃদ্ধি মানেই বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের খবর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

৪. কূটনৈতিক ভাবমূর্তি : আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘মাদক ট্রানজিট নেশন’ হিসেবে চিহ্নিত করার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।

করণীয় ও সুপারিশ

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

প্রযুক্তিগত নজরদারি : নাফ নদী ও উপকূলীয় এলাকায় ড্রোন এবং আধুনিক রাডার সিস্টেমের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি নিশ্চিত করা।

আন্তর্জাতিক চাপ : চীন, ভারত ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে সাথে নিয়ে আরাকান আর্মির মাদক নেটওয়ার্ক ভাঙার জন্য আঞ্চলিক কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।

জিরো টলারেন্স : দেশের অভ্যন্তরে যারা এই মাদকের ডিলার বা সিন্ডিকেটের অংশ, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা এবং তাদের অর্থের উৎস বন্ধ করা।

ক্যাম্পের নিরাপত্তা : রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো এবং মাদক সংশ্লিষ্টতায় জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা।

আরাকান আর্মির মাদক সন্ত্রাস কেবল একটি সীমান্ত সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। এখনই এটি প্রতিরোধ করা না গেলে, এই ‘মাদক বোমা’ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতল ভারত

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে : ডা. শাহাবুদ্দিন

‘যারা কাসেমীর ফাঁদে পড়েছ, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো’

ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য শক্তিশালী দল ঘোষণা বাংলাদেশের

বৃহত্তর নোয়াখালী নারী সংঘ ইতালির আত্মপ্রকাশ

শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের

‘হাসিনার কালো আইন বাতিল করুন, না হয় নিবন্ধন দিন’

বাড়ির পাশের পুকুরের পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু

আহত শিশুকে নেওয়া হলো হাসপাতালে, সড়কে পড়ে ছিল বিচ্ছিন্ন হাত

বিএনপির দুই নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

১০

যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের ২ সদস্য বরখাস্ত

১১

দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রাণ গেল ২ বন্ধুর

১২

লাভের আশায় কৃষকের আগাম ফুলকপি চাষ

১৩

বাউল শিল্পীদের মারধরের ঘটনায় মামলা

১৪

না ফেরার দেশে মেসিকে আর্জেন্টিনা দলে আনার মূল কারিগর

১৫

বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ ঘনীভূত, এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’

১৬

সড়কে লাগানো ধান কেটে প্রতিবাদী পিঠা উৎসব

১৭

পার্বতীপুর মধ্যপাড়া পাথর খনি বন্ধ ঘোষণা

১৮

যা কিছু রেখে গেলেন ধর্মেন্দ্র

১৯

এবার একাত্তর ইস্যুতে যাদের বিচার চাইলেন নাসীরুদ্দীন

২০
X