কৌশিক বসু
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৬:১৭ পিএম
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে

হুমকির মুখে বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা

ছবি : সৌজন্য
ছবি : সৌজন্য

সম্প্রতি কলম্বিয়ার মেডেলিনে শেষ হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এসোসিয়েশন (আইইএ)-এর ২০তম বৈশ্বিক সম্মেলন। ত্রিবার্ষিক এই আয়োজনটি সারা বিশ্বের স্কলারদের একত্রিত হয়ে অর্থনীতির নতুন নতুন চিন্তাধারা ও সর্বশেষ উন্নয়নগুলি নিয়ে আলোচনা করার একটি সুযোগ তৈরি করে। এবছরের সম্মেলনে আগের কিছু বিষয়ের পুনঃমূল্যায়ন জরুরি হিসেবে দেখা হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান ঋণ সংকট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন (আইইএ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন জোসেফ শুম্পেটার। ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-ও এর নেতৃত্ব দিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং এর দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর এক বিরাট ধাক্কা হয়ে আসে। ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যপী সরবরাহ ব্যবস্থা শৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এসব কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে চাপের মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে লড়াইয়ে আবারও বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার মেঘ তৈরি হয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া আইইএ সম্মেলনে এসব বিষয়গুলোকে বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়েছে।

এবছরের সম্মেলনে শ্রম, মজুরি এবং বৈষম্যের উপর ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবের কথা আলোচনায় এনেছেন অনেক আলোচক। অন্যরা বিশ্বায়নের পরিবর্তিত রুপ, একমুখী থেকে বহুমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থানান্তর এবং জাতীয়তাবাদের উত্থানের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। তবে সকলেই এবিষয়ে একম যে বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি মৌলিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

অর্থনীতির স্কলার ড্যানি কোয়াহ তার বক্তৃতায় বিশ্ব অর্থনীতির মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের স্থানান্তরিত করার চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি ১৯৮০ সালে করা তার নিজের গবেষণা এবং আরও কিছু গবেষণার উপর ভিত্তি করে তিনি তার আলোচনা পেশ করেছেন। ১৯৮০ সালে করা গবেষণায় তিনি দেখিয়েছিলেন, বিশ্ব অর্থনীতির মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রটি আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত। এই সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের আধিপত্য ছিল। পূর্ব এশীয় অর্থনীতির যাত্রা শুরু হওয়ার সাথে সাথে অর্থনৈতিক অভিকর্ষের বৈশ্বিক কেন্দ্র পূর্ব দিকে সরে যেতে থাকে।

ড্যানি কোয়াহ তার উপস্থাপনায় দেখিয়েছেন, ২০০৮ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রটি তুরস্কের ইজমিরের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল এবং ভারতীয় ও চীনা অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে। তিনি দেখান, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্র ভারত ও চীনের মধ্যে এসে দাড়াবে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অনেক সুযোগ বয়ে আনবে কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাও বাড়িয়ে দেবে এবং নতুন হুমকির জন্ম দেবে।

আরেকজন আলোচক সের্গেই গুরিয়েভ তার আলোচনায় দেখিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার একটি প্রধান চালক হিসাবে সামনে এসেছে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ। তিনি বলেছেন, জনতাবাদী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান ধারা গণতান্ত্রিক শাসন, নাগরিক স্বাধীনতা এবং উদার বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য একটি ‘অস্তিত্বের হুমকি’ হতে পারে।

সম্মেলনের আলোচক অ্যাডাম সেইডল তার উপস্থাপনায় উল্লেখ করেছেন, হতাশাগ্রস্ত পশ্চিমা ভোটারদের ডানপন্থী নেতাদের পক্ষ নেওয়ার প্রবণতা বিস্ময়কর। সেখানে রাজনীতিবিদদের পছন্দের নীতিগুলি হয়ত তারা যে সমস্যার সমাধান করতে চান তা আরও বাড়িয়ে তুলবে। তিনি আরও বলেন, একটি আর্থিক সংকট পশ্চিমা রাজনীতিতে অতি-ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদীদের অবস্থানকে মজবুত করতে পারে। এবং এটি ঘটলে তা বিরাট বড় সামাজিক সংকটের জন্ম দেবে।

একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও, বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে সফলভাবে একটি মন্দা এড়িয়ে গিয়েছে। যদিও কিছু অর্থনীতিবিদ ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি বড় কোন সংকটে পড়বেনা বলে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন তবে আমি বিশ্বাস করি, এই ধরনের আত্মতুষ্টি বিপথগামী।

বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা মূল্যায়ন করার সময় ধনী দেশগুলোর দিকে মনোনিবেশ করার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে বিশ্লেষকদের মধ্যে। এই প্রবণতা খুবএকটা সুখকর নয়। ২০০৮-০৯ সালের মহামন্দা থেকে আমরা দেখেছি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলো আসে উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে।

কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ তার জনসাধারণের ব্যয় বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। তবুও উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর কাছে ভ্যাকসিন, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ থাকলেও, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের অর্থনীতি মহামারি এবং পরবর্তী খাদ্য ও শক্তি সংকট মোকাবেলায় ব্যাপকভাবে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এই ঋণ কয়েক ডজন দেশকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই অবস্থার শিকার হয়েছে বেশি।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সার্বভৌম-ঋণ সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলো। তাদের বাহ্যিক ঋণের পরিমান ২০২২ সালে সর্বকালের সর্বোচ্চ $৮৮.৯ বিলিয়নে পৌঁছেছিল এবং এই ঋণ ২০২৩-২৪ সালে ৪০% বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হয়। ঘানা এবং জাম্বিয়া ইতোমধ্যেই খেলাপি হয়েছে, ইথিওপিয়া সম্ভবত ২০২৪ সালের মধ্যে খেলাপি হয়ে যাবে এবং আর্জেন্টিনা ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলিতে অভ্যন্তরীণ ঋণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে।

অভিবাসন সংকট আরও বাড়তে পারে এবং উন্নত বিশ্বজুড়ে ডানপন্থি জনতাবাদের উত্থান আরও গভীর হয়ে উঠতে পারে। এসব বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে লেখা হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

উন্নয়নশীল বিশ্বের ঋণ সংকট মোকাবিলা করার জন্য শুধু আধুনিক গবেষণা যথেষ্ট নয়। বরং এর চেয়ে আরও বেশি কিছু প্রয়োজন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করতে হবে।

কৌশিক বসু : বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রবাসী কর্মীর প্রতিবন্ধী সন্তানদের ভাতার জন্য আবেদন শুরু

এপোস্টল কনভেনশন স্বাক্ষর অনুমোদন / বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা 

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে রাইসি যা বলেছিলেন

জনগণ আর ভোটারবিহীন নির্বাচন হতে দেবে না : বিপিপি

‘ইব্রাহিম রাইসি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন’

স্নাতক পাসে অফিসার পদে চাকরি দেবে ব্র্যাক ব্যাংক

বিআরটিসির ২৯৮তম পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত

বিএনপির ৩ নেতাকে শোকজ

রাইসির আত্মার মাগফিরাত কামনায় সৌদি বাদশাহ

দৈনিক কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর শারমিনের পাশে দাঁড়ালেন ইউএনও

১০

শক্তিশালী ব্যালেন্স শিট প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ্যণীয় সাফল্য অর্জন ব্র্যাক ব্যাংকের

১১

১৫৭ উপজেলায় কাল ভোট, ইভিএমে ২৪টি

১২

বজ্রপাতে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু

১৩

অটোরিকশাচালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে : প্রধানমন্ত্রী

১৪

চাঁদার ৫০ টাকা না পেয়ে হত্যা, ৮ বছর পর যাবজ্জীবন

১৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যমুনা ইলেকট্রনিক্সের শোরুম উদ্বোধন

১৬

নির্বাচনের পর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সরকার : ফখরুল

১৭

ইরানের সরকার আসলে কীভাবে পরিচালিত হয়?

১৮

আরও ২২ জন করোনা শনাক্ত

১৯

ঢাকায় ম্যানেজার পদে চাকরি দেবে বিকাশ

২০
X