শরীফ মুস্তাজিব
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪, ০১:০২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের তাপদাহ নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ

২০২৪ সাল হতে চলেছে উষ্ণতম বছর : কে দায়ী?

ছবি : প্রতীকী
ছবি : প্রতীকী

বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মকালে ক্রমবর্ধমান তাপদাহের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সাল সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে চলেছে, সমস্ত জেলায় ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এমন নজিরবিহীন বিপর্যয়ের কারণে দেশের জনসংখ্যা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, হিটস্ট্রোকে কমপক্ষে কয়েকজন ব্যক্তি মারা গেছেন, এবং লক্ষাধিক মানুষ বমি, ডায়রিয়া, তাপ ক্লান্তি, মাথাব্যথা, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, পানিশূন্যতা ইত্যাদ সহ বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়েছেন। প্রচন্ড তাপদাহের কারণে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এই চরম আবহাওয়া বাংলাদেশের পরিবেশের বিপর্যয় এবং দুর্বল পরিবেশগত শাসনের বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে নদী-খাল দখল ইত্যাদি মানুষ্য ক্রিয়াকলাপ পরিবেশের আজকের অবস্থার জন্য দায়ী। বিভিন্ন গবেষণায় গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে। হোয়াইট-কলার অপরাধীরা হাজার হাজার একর বনভূমি দখল ও তা উজাড় করেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানা থেকে ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাসকে দূষিত করেছে। শিল্পের বর্জ্রমিশ্রিত পানি নদী দূষণ করেছে। নদীর তীর দখল করে শিল্পকারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ বিনষ্টের অভিযোগও রয়েছে। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে।

পরিবেশগত শাসন, সামগ্রিক শাসনের একটি মৌলিক স্তম্ভ। এটি শুধু জল এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত নয়, এটি জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও জীবিকা, শিল্প ও অবকাঠামো, জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঙ্গে জটিলভাবে যুক্ত। তবে বাংলাদেশে পরিবেশগত শাসন তার বিচক্ষণ, বিক্ষিপ্ত, পুরানো এবং দুর্বল প্রকৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপস্থিতি সত্ত্বেও, তাদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব নিয়ে প্রায়শই অভিযোগ উঠে। কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে বাংলাদেশের পরিবেশের এমন বিপর্যয় ঘটছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদী-সম্পর্কিত অবৈধ কর্মকাণ্ড চিহ্নিতকরণ ও মোকাবেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। এমন পরিস্থিতিই বাংলাদেশে মানব-প্ররোচিত পরিবেশগত ক্ষতিকে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

আমরা সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় কিছু মৌলিক ত্রুটি চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত, বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে পরিবেশ রক্ষায় এমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, যা দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপ্রচলিত। এটি অত্যন্ত কাঠামোগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো খুব বেশি অগ্রাধিকার পায় না।

বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে সাধারণ জনগণের ভূমিকা খুবই কম। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশগত ক্ষতি রোধে পরিবেশ আদালতে কোনো মামলা দায়ের করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শকের কাছ থেকে অনুমতির প্রয়োজন হয়। ফলে একজন নাগরিকের পক্ষে পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এছাড়া পরিবেশ রক্ষায় নীতি প্রণয়নে স্থানীয় সম্প্রদায় এবং সুশীল সমাজের প্রভাব কম। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে— সুন্দরবনের খারাপ পরিণতি বিবেচনা করে দেশের নাগরিক সমাজ সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধীতা সত্ত্বেও সরকার সেটি স্থাপন করেছে।

দ্বিতীয়ত, পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়, সহযোগিতা এবং যোগাযোগের অভাব রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠান এবং বিভাগ রয়েছে, তাদের সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। উদাহরণস্বরূপ, যখন নদীতে কোনো ঘটনা ঘটে, তখন পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য কে দায়ী হবে তা নির্ধারণ করা কঠি হয়ে পড়ে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়— সবাই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়। পরিবেশগত সমস্যা আরো জটিল হয়ে উঠে যখন সরকারী সংস্থাগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পরিকল্পনা হাতে নয়। কিছু স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তৃতীয়ত, নিয়মিত তদারকি এবং কাজের ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। পরিবেশগত রক্ষা একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া যা রাতারাতি অর্জন করা যায় না। বর্তমান তাপপ্রবাহ আকস্মিক কার্যকলাপের কোনো ফল নয়; বরং, এটি পরিবেশের প্রতি দীর্ঘ দিনের অসদাচরণের ফল। অতএব, পরিবেশেল সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং সকলের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন।

বর্তমান তাপপ্রবাহের আলোচনায় আবার ফিরে আসি। ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট ট্র্যাকার এশিয়ার মতে, গত ২০ বছরে দিনের তাপমাত্রা প্রায় ২.৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এছাড়া গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে এবং শীতকালের বিস্তৃতি সংক্ষিপ্ত হয়েছে। মো. কামরুজ্জামান মিলন, একজন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বর্তমান তাপপ্রবাহকে পরিবেশের বিরুদ্ধে মানুষের কার্যকলাপের পরিণতি বলে মনে করেন। তার পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে দক্ষিণ এশিয়ার তাপপ্রবাহের সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবদান উন্নত দেশগুলোর তুলনায় খুব কম হলেও ক্ষতির শিকার সবচেয়ে বেশি। এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। তাপদাহ কমিয়ে আনতে সরকারকে অধিক উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশ বিধ্বংসী মানব কার্যকলাপ বন্ধে সরকারকে আরো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত যেসব পদক্ষেপের ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে।

তাপ অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বর্তমান জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার উদ্যোগী হতে পারে। জনদুর্ভোগ কমাতেও সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তাপদাহ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এর জন্য নিয়মিত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়ন ও তাদের কাজে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশগত শাসনকে শক্তিশালী করা।

শরীফ মুস্তাজিব: অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক। (দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুদিত)

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কবে হচ্ছে ২০২৯ ক্লাব বিশ্বকাপ, জানিয়ে দিল ফিফা

ফাইনালে মেসি-রোনালদোর রেকর্ড: সংখ্যায় কে সেরা?

কক্সবাজারে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

অক্টোবরের মধ্যে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ফ্লাইট চালুর আশা

পদ্মা ব্যাংকের ১২৯তম পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত

নতুন ভূমিকায় এবার দেখা মিলবে সৌরভ গাঙ্গুলির

কেমন থাকবে আজকের ঢাকার আবহাওয়া

বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করল যুক্তরাষ্ট্র

খুলনায় পিকআপ-ইজিবাইক সংঘর্ষে নিহত ২ 

বিপাকে পড়েছেন শ্রদ্ধা কাপুর

১০

বিয়ের আগে মা হওয়া নিয়ে গর্ববোধ করেন নেহা ধুপিয়া

১১

পেনাল্টি মিসের দোষ রেফারির ঘাড়ে চাপালেন ম্যানইউ অধিনায়ক

১২

৪ ইভেন্টে ৩ রেকর্ডে যে বার্তা দিলেন রিংকি

১৩

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন অন্যতম প্রতিভাবান ক্রিকেটার

১৪

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ নাহিদের

১৫

গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে যে ভয়ের কথা জানালেন তৌহিদ আফ্রিদি

১৬

সুনামগঞ্জে বালু-পাথর লুট ঠেকাতে বিজিবির অভিযান

১৭

টি-টোয়েন্টিতে অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়ে যা বললেন সাকিব

১৮

ইসির শুনানিতে হট্টগোল / রুমিন ফারহানার সমর্থকদের মহাসড়ক অবরোধ, এনসিপির বিক্ষোভ 

১৯

কারাগারে বিক্রমাসিংহে, মুখ খুললেন সাবেক তিন প্রেসিডেন্ট

২০
X