তিন দশকের মধ্যে সর্বশেষ পাঁচ বছরেই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বিশ্ব। ঋণের উচ্চ মাত্রার লভ্যাংশের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এবং অতিমারি পূর্ব যে সকল দেশ অতি দরিদ্র দেশের তালিকায় ছিল তারা নিজেদের পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। পৃথিবীর বৃহৎ অংশজুড়ে প্রবৃদ্ধি খুবই ধীর এবং খুবই উচ্চমাত্রার মুদ্রাস্ফীতি বিদ্যমান। এবং এটার পিছনের থার্মোমিটারটি খুবই ধীরগতিতে চলমান। সাম্প্রতিক মাসের ন্যায় গত বছরের রেকর্ডও ছিল খুবই উষ্ণ।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে, বিশ্ব মোড়লরা জলবায়ু সংকট সমাধান ও দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং সাহসিক পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংক জলবায়ু সংকট সমাধানে কাজ করবে এবং বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাপনা নতুন অর্থ পাবে; এমনকি সংশ্লিষ্ট অর্থ ছাড়ের সাথে নতুন সম্পদের উৎসের জোগান দিবে। যে দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি ঋণ প্রয়োজন তাদের ঋণদাতারা ত্রাণ হিসেবে ঋণ প্রদানের একটি চুক্তি প্রয়োজন। যেখানে সর্বজনীন সম্পদ অপর্যাপ্ত সেখানে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা হিসেবে মালিকানায় অর্থায়নকে অনুঘটক হিসেবে দেখা হবে।
সাহস জোগানো চমকপ্রদ বক্তব্য সত্ত্বেও, ২০২৩ সাল ছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি বিপর্যয়। প্রদত্ত চিত্র অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান সুদের হার, বন্ড এবং ঋণ পরিশোধের অর্থ হলো ২০২৩ সালে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহিত হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্ধিত অর্থায়নকে খর্ব করেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘বিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন’, উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতের অর্থ একত্র করার পরিকল্পনার ক্যাচফ্রেজ, "মিলিয়ন ইন, বিলিয়ন আউট" হয়ে গেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডারদের অর্থায়নে অবাক হওয়ার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বা জোরালো কোনো ভূমিকা রাখেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে অর্থ উত্তোলন করছে; ঋণমুক্তির ধারণা কোথাও হারিয়েছে; স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যয় কমানো মাধ্যমে আর্থিক খেলাপির নৈতিক মানকে আড়াল করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ব নেতারা অনাড়ম্বর ও সাবলীল চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হননি। যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি এবং দুর্বল শাসন কিছু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে (যেমন : চাঁদ, হাইতি, সুদান এবং গাজা) দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে, তবু বিশ্ব প্রতিক্রিয়া নিশ্চুপ। নিজের অধিকার ও সংকট সমাধানে এটি একটি মানবিক বিপর্যয় এবং দুর্বলতার প্রতিচিত্র।
যদি দুর্ভিক্ষপীড়িতরা খাবার না পায় তাহলে কিভাবে একত্রে জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবেলা করবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে বিনির্মাণ করবে? এবং কীভাবে দরিদ্র দেশগুলো বিশ্ব ব্যবস্থাপনাকে বিশ্বাস করবে যেন তাদের ছেড়ে এগিয়ে না যায়, এমনকি ব্যবস্থাপনা যদি না মৌলিক চ্যালেঞ্জকে শনাক্ত করতে পারে? অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থনীতিক নেতারা ওয়াশিংটন, ডিসিতে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর বসন্ত বৈঠকের জন্য জড়ো হচ্ছেন, যেখানে তারা বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করবেন এবং এটিকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা তৈরি করবেন। কিন্তু শক্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যদি ২০২৩ সালের মতোই প্রতিশ্রুতিগুলো সমতল পতিত হয় তাহলে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে চারটি বৃহৎ ধারণা দেয়া হয়েছে:
প্রথমত, মূলধনের প্রবাহকে বিপরীতমুখী করন, তাহলে স্বল্প আয়ের দেশগুলি বেশি সমর্থন পাবে এমনকি বেসরকারি ঋণদাতাদের ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারবে। স্বল্প মেয়াদি অর্থ হলো, বহুপাক্ষিক উন্নয়নমূলক ব্যাংকগুলো তাদের উদ্ভাবনী আর্থিক ধারণাগুলো হাইব্রিড মূলধন,, ঝুঁকি প্রশমন খাত এবং বন্ধকীর মতো খাতগুলোতে প্রসারিত হবে। সামান্য দীর্ঘ মেয়াদি অর্থ হলো, শেয়ার হোল্ডারদের থেকে নতুন অর্থ নিয়ে নতুনভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধি হবে; সেক্ষেত্রে শেয়ার হোল্ডিং দেশগুলোর আইনগত অনুমোদন প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, এমডিবি কে জলবায়ু সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও বড় ঝুঁকি গ্রহণ প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর করতে হবে। উন্নয়ন ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে চারিপাশের সংস্কারের প্রচেষ্টাগুলো পরিমাপের সময় এসেছে। ঝুঁকি গ্রহণে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য ধনী দেশগুলো যারা বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার বৃহত্তম অংশীদার তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অ্যাসোসিয়েশন একটি অত্যন্ত কার্যকর প্রতিষ্ঠান যা নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে অত্যধিক প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করে। আসন্ন চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আইডিএ পরিপূর্ণের আহ্বান করেছেন, যেন বিশ্বের কোনো কিছু কমতি না থাকে।
চতুর্থত, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা। গত বছর, জাতিসংঘ মানবিক ত্রাণের জন্য যা চেয়েছিল তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এজন্য 2024 সালের লক্ষ্যগুলি হ্রাস করতে হয়েছে। খাদ্য মানবিক বিপর্যয় প্রশমিত করবে এবং সন্দেহপ্রবণ দেশগুলিকে প্রমাণ দেবে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এখনও কাজ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে ভারত এবং মেক্সিকো পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধেক দেশেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সরকারের প্রতি ব্যাপক অবিশ্বাস এবং তাদের প্রতিশ্রুতি এখন বিশ্বব্যাপী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এবং আমরা প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বিরোধাভাস দেখতে পাচ্ছি। প্রচলিত তথ্য মতে, রাজনীতিকরা নির্বাচনে জেতার জন্য নিজেদের প্রচারে ও অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মনোনিবেশ করে থাকেন। আমরা আশা করি, ঐতিহাসিকরা ফিরে তাকাবেন, এমন একটি সময় অধিবেশন চলছিল যখন বিশ্ব নেতারা গুরুত্বের সাথে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করছিলেন। সমস্যাটি মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। প্রতিচিত্র এমন যে, গ্রুপ ২০ এর বিশেষজ্ঞরা এমডিবি সিস্টেমকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করছে। মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুঁজে পাওয়াটা বর্তমানে খুবই কঠিন।
মূল: লরেন্স এইচ. সামারস এবং এন.কে. সিং। ভাষান্তর: মামুনুর রশীদ
মন্তব্য করুন