হজ হলো এমন একটি পবিত্র স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা যেখানে সম্মিলিতভাবে ইবাদত ও বিশ্বাসের ভক্তিমূলক চর্চার জন্য সবাই জড়ো হন। যা অনাদিকাল থেকে মানুষের মৌলিক অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে আছে।
বিভিন্ন ধর্মেই এমন গুরুত্বপূর্ণ চর্চা রয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মতো সবারই ধর্মীয় উপাসনার অংশ হিসেবে তীর্থকেন্দ্র রয়েছে।
অভিন্ন উদ্দেশ্যে কোথাও একত্রিত হওয়ার অধিকার ও প্রয়োজনীয়তা মানুষের সহজাত এবং অন্তর্নিহিত। এমনকি আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতেও গণজমায়েতের অধিকারকে বৈধ ও মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
হজের মধ্যদিয়ে মিলিয়ন মানুষ একটি নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হন, যা সাধারণত একেবারে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। খেলাধুলা ও সঙ্গীত উৎসবের মতো ধর্মনিরপেক্ষ বড় জমায়েতগুলোর ন্যায় ধর্মপ্রাণ তীর্থযাত্রীদের সহিংস ঘটনার দ্বারা তীর্থস্থানের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার নজির বিরল। সন্দেহ নেই যে কিছু ধর্মান্ধ কথিত ধর্মীয় উদ্দেশ্য হাসিলের নামে লোকজনকে জড়ো করে উসকানিমূলক প্রচারণা চালায়। তবে এদের কর্মকাণ্ড তীর্থযাত্রী কিংবা কোনো ধর্মের মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে না।
আমাদের এই বর্তমান বিশ্ব যুদ্ধ, সহিংসতা, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, বিদ্বেষ, পারিবারিক সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, মাদক নির্ভরতা, যৌন কর্মী হিসেবে পাচার, গৃহহীনতা, প্রতিটি শিল্পে প্রতারণা, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও সরকারে দুর্নীতি, মানসিক স্বাস্থ্য সংকট এবং ক্রমবর্ধমান জলবায়ু জরুরি অবস্থায় জর্জরিত।
অন্যদিকে, বেশিরভাগ সেবা ও শিল্পের অটোমেশনে রূপান্তর, একটি শক্তিশালী বিশ্ব ব্যবস্থায় যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের ফলে মানুষের জীবন ও শ্রমের মূল্য ভুলে যাওয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় বেশিরভাগ ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন ও সংস্থাগুলো ঐক্য ও শান্তির বদলে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ।
এমন বাস্তবতায় মানবতার জন্য আমাদের শান্তিপূর্ণ মানবিক মিথস্ক্রিয়া এবং শান্তির পথ প্রশস্ত করতে হলে অন্তত ধর্মীয় তীর্থযাত্রী হিসেবে নিজেদেরকে পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
প্যাট্রিক ডেনিনের ২০১৮ সালে লেখা ‘কেন উদারতাবাদ ব্যর্থ হলো’ বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, আধুনিকতার মিশন ও উদার সমাজ, ব্যক্তির মুক্তি ও স্বাধীনতার নামে যে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থার ধারণা করা হয়েছিলো তা বড় ধরনের ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছে। তাই অন্তত আক্ষরিক এবং প্রাচীন প্রথার দ্বারা আধুনিকতার প্রতিস্থাপন হওয়া উচিত।
ইবাদতের জন্য জমায়েত হওয়া এবং ইবাদতস্থলকে রক্ষার অধিকারের বিষয়ে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে জোর দেয়া হয়েছে। ‘আল্লাহ যদি কিছু লোকের দ্বারা আগ্রাসন প্রতিহত না করতেন তাহলে আশ্রম, চার্চ, সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) এবং মসজিদগুলো ধ্বংস হয়ে যেত, যেখানে প্রতিনিয়ত আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব শক্তিমান ও সব ক্ষমতার অধিকারী।’ (সুরা আল হজ, পারা-২২, আয়াত-৪০)
মুসলিমদের জন্য হজের মাসে তীর্থযাত্রা সার্বজনীন। হজে গমনের অর্থই হলো- পবিত্র মক্কায় আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। কাবা হিসেবে পরিচিত ঘরটির পুনঃনির্মাতা হলেন আব্রাহাম (হজরত ইব্রাহিম আ.) যাকে ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ধর্মেরই প্রতিষ্ঠাতা পিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
এই তিন ধর্মে বিশ্বাসীদের সবাই নিজেদেরকে আব্রাহামের (ইব্রাহিম আ.) প্রতি বিশ্বাসী বলে দাবি করেন। সম্প্রতি ইব্রাহিমের ধর্মের প্রতি বিশ্বাসীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার আগ্রহ দেখা দিয়েছে, যেটিকে একটি মহৎ উদ্যোগ হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
আর এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, (হে নবী) আপনি বলে দিন, ওহে কিতাবের অধিকারী! ইহুদি ও খ্রিস্টানরা, এসো আমরা এমন একটি কথায় ঐক্যমত্যে পৌঁছাই যেটি সার্বজনীন। আর তা হলো, আমরা এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করব না, তার সঙ্গে কাউকে শরিক (অংশীদার) করব না কিংবা আল্লাহ ব্যতীত একে অপরকে স্রষ্টা হিসেবেও গ্রহণ করব না।(সুরা আল ইমরান, পারা-৩, আয়াত-৬৪)
ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন একজন নবী যিনি হজের নিয়ম-কানুনের প্রতিষ্ঠাতা। তার উত্তরসূরিরা দীর্ঘদিন ধরে যথাযথভাবে সেগুলো পালন করে আসছিলেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই নিয়ম-কানুনগুলো কলুষিত করা শুরু হয় এবং অনেক বিধান পরিবর্তন করা হয়। হজরত মুহাম্মদের (স.) জন্মগ্রহণের সময় হজের ইবাদতের মূল সৌন্দর্য হারিয়ে গিয়েছিল এবং হজকে চিহ্নিত করাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। নবী মুহাম্মদ (স.) যখন হজব্রত পালন করেন তখন তিনি হজের মূল বিধানগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে মুহাম্মদ (স.) নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী বর্তমানে মুসলমানরা হজ পালন করে আসছেন।
ইব্রাহিমে (আ.) বিশ্বাসী লোকজনকে একতাবদ্ধ হতে হলে ইব্রাহিম (আ.) প্রচারিত এবং তার অনুসৃত ‘সভ্যতাগত মূল্যবোধে’র (যা মিল্লাত নামে পরিচিত) প্রতি বিশ্বস্ত হতে হবে। মিল্লাতের বেশিরভাগ মূল্যবোধই মুসলমানদের হজে প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
মুসলমানরা যখন হজের পোশাক পরিধান করেন তখন তাদের জন্য তর্ক বিতর্ক, ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি কিংবা হানাহানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
ওই সময় তাদের জন্য মশা-মাছি মারা থেকে শুরু করে শরীর থেকে সামান্য রক্ত বের হয় এমনভাবে আঁচড়ানো এবং পশু শিকারও নিষিদ্ধ। নিজেকে অথবা অপরকে কোনোভাবে আঘাত বা ক্ষতিগ্রস্ত করাও নিষেধ, কেউ করে ফেললে সেজন্য অবশ্যই তাকে চড়া মূল্যের জরিমানা (দম) পরিশোধ করতে হয়।
পবিত্র কুরআনে কাবার চারপাশের নির্দিষ্ট এলাকাকে ‘হারাম’ বা অভয়ারণ্য এবং নিরাপদ ও নিরাপত্তার স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতি বছর দুই মিলিয়নের (২০ লাখ) বেশি মানুষকে এই নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। যদিও মারামারি, চুরি, হয়রানির মতো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা হজের সময় ঘটে থাকে। তবে ঐক্যের যে সুবাতাস সেখানে প্রবাহিত হয় তা সত্যিই অতুলনীয়।
চলুন, ১৯৬৪ সালে মক্কা থেকে লেখা চিঠিতে ম্যালকম এক্স কি বলেছিলেন তা স্মরণ করি-
‘আব্রাহাম (ইব্রাহিম), মুহাম্মদ এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অধিকারী সব নবীদের প্রাচীন এই পুণ্যভূমিতে এমন আন্তরিক আতিথেয়তা, নানা বর্ণ ও গোত্রের মানুষের মাঝে সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনার অভূতপূর্ব চর্চা আমি জীবনে কখনো দেখিনি। গত এক সপ্তাহে আমার চারপাশে নানা বর্ণের মানুষের উদারতা দেখে আমি বাকরুদ্ধ এবং মন্ত্রমুগ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারো তীর্থযাত্রী (হাজী) এখানে এসেছেন। তাদের শরীরের বর্ণ কিংবা গড়নে ভিন্নতা থাকলেও আমরা সবাই একই রীতি ও নীতি পালনের মাধ্যমে একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনার প্রদর্শনী করছি। অথচ, অ্যামেরিকায় আমার অভিজ্ঞতা থেকে এই বিশ্বাসই জন্মেছিল যে, শেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গরা কখনো একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না। গত ১১ দিনে এখানে বিশ্বের মুসলিমদের সঙ্গে আমি এক প্লেটে খেয়েছি, একই গ্লাস থেকে পান এবং এক বিছানায় ঘুমানোর পাশাপাশি একই স্রষ্টার প্রার্থনা করেছি। এখানে শেতাঙ্গ মুসলমানদের কথা ও কাজে যে আন্তরিকতা অনুভব করেছি, একই ব্যাপার আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নাইজেরিয়া, সুদান ও ঘানার মুসলমানদের বেলাতেও ঘটেছে।’
এক স্রষ্টার উপাসনার মাধ্যমে একতা, সব সময় সব মানুষের সংহতি এবং কারো অনিষ্ট না করাই মুসলমানদের হজের মূলকথা। এটাই আব্রাহামিক ধর্মমতের বিধান যা মুহাম্মদ (স.) এর মূল বার্তা। যারা ধর্ম ও ইসলামকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখেন তারা সার্বজনীন এই দূরদর্শিতার প্রতি দ্বিতীয়বার নজর দিতে পারেন। বিশ্বের যেসব প্রভাবশালী এই পৃথিবী থেকে অসুস্থতা মনুষ্য সৃষ্ট সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে চান, তাদের উচিত এমন একটা নির্দিষ্ট ফর্মুলার মধ্যদিয়ে সেটি করা যা ঈশ্বর প্রদত্ত। কারণ তিনিই পরম করুনাময় ও পরম দয়ালু।
আল জাজিরার ‘Hajj proves religion can inspire peace’ অবলম্বনে অনূদিত।
মূল : শায়খ এম এ খোলওয়াদি, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের শিকাগোতে অবস্থিত দারুল কাসিম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক।
অনুবাদ : মোহসিন কবির
মন্তব্য করুন