ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর থেকে সেখানে প্রতিরোধকামী সংগঠন হামাসের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ছাড়াও কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও তাদের জরিপের এমন ফলাফল তুলে ধরেছে।
ফিলিস্তিনের প্রখ্যাত জরিপ পরিচালনাকারী খালিল শিকাকি গত বুধবার ফিলিস্তিনিদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছেন। গত ৭ অক্টোবরের পর তৃতীয়বারের মতো প্রকাশিত ওই জরিপ বলছে, পশ্চিম তীর এবং গাজার ৬১ শতাংশ ফিলিস্তিনি চান, হামাসই গাজা উপত্যকা শাসন করবে এবং প্রতিরোধকামী সংগঠনটির প্রতি এই সমর্থন ফাতাহকে ছাড়িয়ে গেছে। জরিপে ১,৫৭০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এর মধ্যে পশ্চিম তীরের ৭৬০ জন এবং মধ্য এবং দক্ষিণ গাজায় ৭৫০ জনের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
এ ছাড়া ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস কর্তৃক ইসরায়েলে ইতিহাসের নজিরবিহীন হামলার পর ওই বছরের ডিসেম্বরে গাজা ভিত্তিক সশস্ত্র প্রতিরোধ গ্রুপটির ব্যাপারে ফিলিস্তিনিদের মনোভাবের ব্যাপারে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে হামাসের প্রতি ব্যাপক সমর্থন বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। ‘প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ’ (পিসিপিএসআর) পরিচালিত ওই জরিপে দেখা যায়, ফিলিস্তিনের প্রতি চারজনের তিনজনই ইসরায়েলে হামাসের হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। ফাতাহ নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের জনপ্রিয়তা ফাতাহর তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে যায়। বিপরীতে ইসরায়েল ও পশ্চিমা সমর্থিত মাহমুদ আব্বাস সরকারের ব্যাপারে ৯০ শতাংশ ফিলিস্তিনি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশের বিষয়টি জরিপে উঠে আসে। কিন্তু এসব জরিপের ব্যাপারে বরাবরই ইসরায়েলি প্রশাসনে গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমগুলোতেও এ ব্যাপারে চালানো হয় নেতিবাচক প্রচারণা। ইসরায়েলের চাওয়া অনুযায়ী, হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে অ্যামেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়া।
ইসরায়েলি গণমাধ্যম জেরুজালেম পোস্টের এক অনলাইন প্রতিবেদনে সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপের সত্যতাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনটিতে গত ৯ জুন, রোববার নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধের কথা তুলে শিকাকি'র সমীক্ষাকে মনগড়া বলে আখ্যা দেওয়া হয়। টাইমসের হেডলাইনে বলা হয় ‘হামাসের অধীনে গাজাবাসীরা তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলছে’। টাইমসের অনলাইন নিউজের ওই হেডলাইনের খবরটি ছিলো এমন- ‘যুদ্ধ যতই বাড়ছে গাজার বাসিন্দাদের মাঝে হামাসের বিরোধিতাও ততই বাড়ছে’। টাইমসের নিবন্ধের বিষয়টি সামনে এনে জেরুজালেম পোস্টে বলা হয়- ‘নিউইয়র্ক টাইমসের একজন জ্যেষ্ঠ লেখকের নিবন্ধের তিনদিন পর, ফিলিস্তিনের একজন প্রখ্যাত জরিপ পরিচালনাকারীর জরিপের ফলাফল টাইমসের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হেডলাইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই মনে হচ্ছে।’
জেরুজালেম পোস্টের রিপোর্টে আরও বলা হয়, জরিপে যখন ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের প্রতি জোরালো সমর্থন দেখা যাচ্ছে, তখন নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধটি গত কয়েক মাসে প্রায় ডজনখানেক গাজাবাসীর সাক্ষাতকারের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়। ওই নিবন্ধে হামাসের গাজা শাসন নিয়ে ভিন্ন এক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। তবে, টাইমসের নিবন্ধে এটা স্বীকার করা হয়েছে যে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে গাজায় বিরাজমান জটিল পরিস্থিতির মধ্যে জনমত গ্রহণ খুবই কঠিন ব্যাপার এবং অনেক ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধীও। এতে বলা হয়- ‘সাম্প্রতিক কিছু জরিপে গাজায় হামাস ও এর নেতাদের ব্যাপারে দুর্বল অথবা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটেছে।’
২০০৬ সালে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের ভোটে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও হামাসকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। বরং ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের অনুগত ফাতাহ প্রধান মাহমুদ আব্বাসের হাতেই অধিকৃত পশ্চিম তীরসহ অন্য এলাকাগুলোর শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। তখন গাজা উপত্যকার শাসনভার গ্রহণ করে হামাস। এরপর থেকে গাজায় প্রায়ই হামলা চালাতে থাকে ইসরায়েলি বাহিনী। ছোট-খাটো অভিযানের বাইরে ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ সালে চালানো বড় ধরনের নৃশংস হামলায় গাজার বিপুল সংখ্যক নিরীহ ফিলিস্তিনি হতাহত হয়। বিমান হামলায় ধ্বংস করে দেয়া হয় তাদের অসংখ্য বাড়িঘর। এভাবে প্রায় আট দশক ধরে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর অব্যাহত ইসরায়েলি নৃশংসতার কারণে গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ফলে দখলদার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হামাসসহ গড়ে ওঠা প্রতিরোধকামী একাধিক সংগঠন লড়াই করছে।
টাইমসের নিবন্ধে গত মার্চে পশ্চিম তীর ভিত্তিক ‘ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক প্রোগ্রেস’ পরিচালিত একটি সমীক্ষার কথা তুলে ধরে বলা হয়, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী তিন চতুর্থাংশ হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং ইসমাইল হানিয়ার বিরোধিতা করেছেন। তবে, ওই প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে শিকাকি'র প্রতিবেদনে আপত্তি তোলা হয়। তাতে বলা হয়, ‘অন্য সমীক্ষাগুলোতে আরও বেশি মিশ্র চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, ‘প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ ইন গাজা'র গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি সমীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, গাজায় হামাস নেতাদের সমর্থন সামান্য বেড়েছে। ডিসেম্বর থেকে ওই অঞ্চলে হামাস নেতৃত্ব নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ বেড়েছে।
ইসরায়েলি পত্রিকাটির দাবি, গত মার্চে প্রকাশিত টাইমসের নিবন্ধের সঙ্গে শিকাকির সাংঘর্ষিক জরিপে হামাস এবং গ্রুপটির নেতা সিনওয়ারের প্রতি সন্তোষ প্রকাশের হার অনেক বেশি। ৬৫ শতাংশেরও বেশি ফিলিস্তিনি জনগণ যুদ্ধকালীন সিনওয়ারের কর্মকাণ্ডে সন্তোষ জানিয়েছেন। এর মধ্যে পশ্চিম তীরে ৭৬ শতাংশ এবং গাজায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে, হিব্রু ভাষায় প্রকাশিত 'মারিভ'র সাংবাদিক লিল্যাক সিগ্যান কর্তৃক গত ৭ অক্টোবর থেকে ৭ মার্চের ঘটনাবলী নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। সেখানে যুদ্ধের তীর্যক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা এবং ইসরায়েলের সমালোচনা করা হয়। ফলে এই জরিপের ফলাফল মনগড়া বলেই ইঙ্গিত করে।
পত্রিকাটির মতে, প্রথমত-জরিপ অনুযায়ী গাজার ৫৭ শতাংশ এবং পুরো ফিলিস্তিনের ৬৭ শতাংশ মানুষ ৭ অক্টোবর হামাসের হামলাকে সঠিক বলে মূল্যায়ন করেন। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনের ৭৫ শতাংশ এবং ৬৪ শতাংশ গাজার বাসিন্দা যুদ্ধকালীন হামাসের পারফরম্যান্স নিয়ে সন্তোষ জানিয়েছেন। তাই এসব পরিসংখ্যানকে উড়িয়ে দিয়ে জেরুজালেম পোস্টে উল্টো দাবি করা হয়, হামাসের কারণেই গাজার বর্তমান ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উপত্যকায় যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এবং সেখানকার বাসিন্দারা যে গণহত্যার শিকার হচ্ছে এর পুরো দায় হামাসের ওপর চাপানো হয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে ফিলিস্তিনিদের কোনো মতামত প্রকাশ করেনি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমটি।
ইসরায়েলের প্রভাবশালি সংবাদমাধ্যম জেরুজালে পোস্টে ‘প্যালেস্টিনিয়ান পোল শোজ হামাস ওয়াইডলি সাপোর্টেড ইন গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’ (Palestinian poll shows Hamas widely supported in Gaza, West Bank) শিরোনামে প্রকাশিত বিশ্লেষণ থেকে অনুবাদ করেছেন মোহসিন কবির।
মন্তব্য করুন