আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুব সংগঠন ‘জাতীয় যুবশক্তি’। শুক্রবার (১৬ মে) বিকেলে রাজধানীর গুলিস্তানের শহীদ আবরার ফাহাদ অ্যাভিনিউতে আয়োজিত আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ১৩১ সদস্যের কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে এই সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় যুবশক্তির আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও মুখ্য সংগঠকের নাম ঘোষণা করেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী। জাতীয় যুবশক্তির আহ্বায়ক হিসেবে অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম, সদস্য সচিব ডা. জাহেদুল ইসলাম ও মুখ্য সংগঠক ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ সোহেলের নাম ঘোষণা করা হয়। যুবশক্তির আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়া তারিকুল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। সদস্যসচিব জাহেদুল ইসলাম পেশায় চিকিৎসক। আর মুখ্য সংগঠক ফরহাদ সোহেল একজন প্রকৌশলী।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এই তিনজনের নাম ঘোষণার পর কমিটির আরও কিছু নেতার নাম ঘোষণা করেন জাহেদুল ইসলাম৷ তিনি জানান, তাদের কমিটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে তুহিন মাহমুদ এবং জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী ও নাহিদা বুশরা দায়িত্ব পালন করবেন। আরও কয়েকজন পদধারী নেতার নাম উল্লেখ করে জাহেদুল বলেন, তাদের ১৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
এ সময় এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কারী হান্নান মাসউদ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে দুপুরের পর থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দেন জাতীয় যুব শক্তির নেতাকর্মীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারা অনুষ্ঠানস্থলে আসেন।
এ সময় এনসিপি সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। মানবিক করিডরের প্রয়োজন আছে কিনা, সেই করিডরের নিয়ন্ত্রণ কাদের কাছে থাকবে, সেই করিডোর দিয়ে কি পারাপার হবে, প্রত্যেকটা বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করতে চায় না। বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রত্যেকটা পক্ষকে বলতে চাই, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, জুলুমবাদের বিরুদ্ধে, স্বৈরতান্ত্রিক বিরুদ্ধে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও সব ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
আখতার হোসেন বলেন, চব্বিশের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগকে আমরা রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করেছি। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আইনগতভাবে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এখন সময় মতাদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা। বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ যাতে ফিরে না আসে, এক্ষেত্রে জাতীয় যুবশক্তি ভূমিকা পালন করবে।
এনসিপির সদস্য সচিব, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল সময় অতিক্রম করছে। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আন্দোলন সফল হয়েছে। তারপর অন্তর্বর্তী সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশের একটি অংশ ও বিদেশি কিছু কুশীলব, তারা গ্রহণ করতে পারছে না। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ যারা গ্রহণ করতে পারছে না তাদের বলতে চাই, বাংলাদেশে গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী, স্বৈরতান্ত্রিক কোনো শক্তিকে আপনারা কি আবার পুনরুজ্জীবিত করতে চান?
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আজকে আমরা এমন একটি ঐতিহাসিক সময় দাঁড়িয়েছি, যে সময় আমাদের যুব উইং গঠন করছি। যার নাম আমরা দিয়েছি জাতীয় যুবশক্তি। আমরা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করতে সক্ষম এখনো হয়নি। এ লড়াইটা চলমান থাকবে। তেমনিভাবে নতুন বন্দোবস্ত এবং মর্যাদাকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামের পতাকা যাদের নেতৃত্বে থাকবে তারাই হলো আগামী দিনের যুবশক্তি। আর সেই যুবশক্তির প্রাণভমরা আজকে আমাদের সামনে বসে আছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা গত ৩ মাস জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশের মধ্যদিয়ে ৬৪ জেলায় যোগাযোগ করেছিলাম। কীভাবে ফ্যাসিবাদী কায়দা থেকে বের হয়ে নতুন একটি পদ্ধতির মাধ্যমে, নতুন একটি সিস্টেমের মাধ্যমে, নতুন একটি বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে যুবকদের জন্য কাজ করা যায়। সেজন্য সেই প্রক্রিয়া শুরু করি। আমরা ৬৪ জেলায় ভ্রমণ করেছিলাম। সেখানে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সমাজের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাদের সঙ্গে কথা বলেছি।
যা আছে ঘোষণাপত্রে
অনুষ্ঠানে জাতীয় যুবশক্তির ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আহ্বায়ক তারিকুল ইসলাম। এ সময় তিনি বলেন, আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ধারাবাহিক লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণে—যার সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের উপনিবেশবিরোধী আজাদীর লড়াইয়ে, পরবর্তীতে পরিণত হয়েছে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে, আর এক নতুন দিশা ও প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছে ২০২৪-এর ঐতিহাসিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই অভ্যুত্থান কেবল ক্ষোভের বিস্ফোরণ নয়—এটি ছিল একটি নতুন রাজনৈতিক কল্পনার জন্মমুহূর্ত, যেখানে তরুণেরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে: বর্তমান ব্যবস্থা আর চলতে পারে না, প্রয়োজন এক নতুন রাষ্ট্রকল্প, এক নতুন পথ। নতুন রাষ্ট্র ও রাজনীতির আকাঙ্ক্ষাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল। যুবশক্তি জুলাই গণঅভ্যুত্থানেরই ধারাবাহিকতা।
তিনি বলেন, আমরা চাই দায় ও দরদের রাজনীতি—যেখানে নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব গ্রহণ, সহানুভূতিশীলতা, সহনশীলতা এবং নাগরিকের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ। দায়িত্ব, সহানুভূতি ও মানবিকতা ছাড়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দায় ও দরদের রাজনীতিই অধিকার ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করে। তাই দায় ও দরদের অনুশীলন আমাদের রাজনীতির অন্যতম নৈতিক ভিত্তি। আমরা চাই এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে নাগরিক মর্যাদা কাগজে নয়, বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হবে; যেখানে রাষ্ট্র সকল ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিসত্তার মর্যাদা দেবে; যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কেবল স্লোগান নয়, রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি হবে। যে কোনো প্রকার ধর্মবিদ্বেষ ও উগ্রতাকে পরিহার করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবোধ ও সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমরা সম্প্রীতি, ইনসাফ ও নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
‘বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অঞ্চলজুড়ে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত শক্তি হিসেবে নেতৃত্ব নিতে হবে বাংলাদেশকে। সেই নেতৃত্বকে গ্রহণ করতে হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সভ্যতাগত রুপান্তর প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন পথ দেখাবে বাংলাদেশ। আমরা চাই একটি জাতীয় অর্থনীতি, যা কেবল প্রবৃদ্ধির হিসাব নয়, ইনসাফ ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে; যেখানে কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি হবে সবার নাগালের মধ্যে। রাষ্ট্রে তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। তরুণরা উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে। দুর্নীতিমুক্ত ও মেধাভিত্তিক একটা রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার জন্য যুবশক্তি কাজ করবে।’
তিনি আরও বলেন, বহুরূপী চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে—চাকরির সংকট, উদ্যোক্তার পথে বাধা, প্রযুক্তিহীন শিক্ষা, মাদকের ভয়াবহ বিস্তার এবং এক অন্তঃসারশূন্য বাজারনির্ভর সংস্কৃতি তরুণদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা চাই, এই সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্র বিনিয়োগ করুক সৃষ্টিশীল কর্মসংস্থান, উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও নৈতিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণে। প্রতিটি তরুণ যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে—চাকরি করবে, নাকি উদ্যোগ গড়বে; এবং কোনো তরুণ যেন মাদক নয়, নিজের স্বপ্নের মধ্যেই হারিয়ে যেতে শেখে। আমাদের দাবি—রাষ্ট্র এই দায় স্বীকার করুক, এবং তরুণদের পাশে নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুলুক।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আমাদের প্রধান দাবি—একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তো ও নতুন প্রজাতন্ত্র। আমরা বিশ্বাস করি, সময় এসেছে নতুন সংবিধানের, নতুন রাজনৈতিক চুক্তির, যা এই প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ব করবে, যা এই প্রজন্মের মর্যাদা ও সুযোগ নিশ্চিত করবে, যা ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি, ন্যায্যতা, পরিবেশ ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে এক নতুন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। আমরা সেই প্রজন্ম, যারা অতীত জানে, বর্তমান দেখে এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণে ভয় পায় না। আমরা ৪৭-এর আজাদীর আত্মা বহন করি, ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত, আর ২৪-এর অভ্যুত্থানের অঙ্গীকারে শপথবদ্ধ। আমরা কেবল উত্তরাধিকার নয়—আমরাই আগামী। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব ও হিস্যা নিশ্চিত করবে যুব শক্তি। আগামীর সংসদ ও আগামীর বাংলাদেশ হবে তরুণদের, নতুনদের।
মন্তব্য করুন