বিভিন্ন অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন সংগঠনটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। এবার উমামা ফাতেমার করা অভিযোগ নিয়ে মুখ খুললেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
শনিবার (২৯ জুন) রাতে দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন টকশোতে যোগ দিয়ে উপস্থাপকের প্রশ্নের জবাবে সারজিস আলম বলেন, উমামা ফাতেমা যেসব অভিযোগ তুলেছেন, তার মধ্যে সব অভিযোগ ফেলে দেওয়ার মতো না। আবার সব গ্রহণ করার মতোও না।
এনসিপির এই নেতা বলেন, গণঅভ্যুত্থানে যারা নারীদের সংগঠিত করেছেন, তাদের মধ্যে উমামা ফাতেমা অন্যতম। তিনি বলেন, এ গুরুত্বটা ছিল বলেই উমামা আমাদের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মের কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মনে হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের প্রত্যেকটা জিনিস দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।
সারজিস আরও বলেন, এটা সত্যি যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সব বিষয় যেভাবে হওয়ার প্রয়োজন ছিল, আমাদের প্রত্যাশা যেমনটা ছিল, সেভাবে সব হয়নি। এ সমগ্র সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন করে যাচ্ছি, প্রথমবারের মতো যাচ্ছি। এ কারণে হয়তো অনেকে নিজের অজান্তে এমন অনেক কিছু করছে, যেটা অপরপ্রান্ত থেকে মনে হচ্ছে অপ্রত্যাশিত। আবার কারও কাছে মনে হচ্ছে এটাই ঠিক।
তবে বিষয়গুলো নিয়ে উমামা ফাতেমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন সারজিস। তিনি বলেন, আমারও জানা উচিত তার কোন জায়গায় সীমাবদ্ধতা মনে হয়েছে। এ জিনিসগুলো নিয়ে আমরা কীভাবে কাজ করতে পারি।
এর আগে শুক্রবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া পোস্টে উমামা ফাতেমা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। ওই পোস্টে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন।
ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছে গত পরশু। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখানেই শেষ হলো।’
তিনি আরও লেখেন, ‘এনসিপি নামক রাজনৈতিক দলটি গঠনের পর আমি জুলাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো করার দায়বদ্ধতা থেকে এই ব্যানার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু দলীয় লেজুড় ও প্রেসক্রিপশনের বাইরে এই ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ত। তাই আমার উপর অনলাইন, অফলাইনে ভয়াবহ চাপসৃষ্টি করা হয় যাতে আমি এই ব্যানার নিয়ে কাজ না করি। আমি পুরো বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই একটা Goodwill থেকে ব্যানারকে সচল করার চেষ্টা করেছিলাম। পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই। যে মানুষগুলোর সাথে আমি পাশে দাঁড়ায়ে মিটিং করছি, মিছিল করছি তারাই পরিকল্পতিভাবে জুনিয়রদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে Smear campaign চালায়। মানুষ বাইরে যত ভালো সাজার চেষ্টা করুক ভিতর থেকে কতটা ছোটলোক হতে পারে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই ওই সময়গুলোতে। এই সো কল্ড সহযোদ্ধারা মানুষকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করে, প্রয়োজন শেষ হলে ছুড়ে ফেলতে এক মুহূর্তও লাগে না। আমি মার্চ-এপ্রিল মাসে এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি পোকার মতো ভিতর থেকে প্ল্যাটফর্মকে সুবিধাবাদীরা খেয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ, আমি বলব বিভিন্ন শাখা কমিটিতে অনেক Goodwill-এর মানুষ ছিল, যারা পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে কমিটিতে আসছিল। চেষ্টা করছে কাজ করার। কিন্তু তারাও এই সুবিধাবাদীদের কাছে জায়গা করতে পারেনি। আমার সাথে অনেকের কথা হয় এখনো। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে চেষ্টা করি সাজেশন দেওয়ার, হেল্প করার।’
উমামা ফাতেমা লেখেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় ইভেন্ট দেখার পর চোখের সামনে সবকিছু ভেঙে পড়তে দেখাটা অনেক অনেক কঠিন। পরবর্তীতে আমার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের সাথে পরামর্শ করে এই ব্যানার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বৈষম্যবিরোধী ব্যানার থেকে সরাসরি পদত্যাগ না করলেও এই ব্যানারের সাথে কার্যত সম্পর্ক ছিন্ন করি গত এপ্রিল-মে মাসে। প্ল্যাটফর্ম থেকে Empowering our Fighters নিয়ে কাজে মনোযোগ দিই। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল, সেসবে মনোযোগ দিই। অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পদত্যাগ করব। একটা পদত্যাগপত্র লিখে আর জমা দিইনি। পারিনি আসলে। রাজনৈতিকভাবে ভাবলে পদত্যাগ করে আসাটা সব থেকে সহজ। কিন্তু আমি তো মানুষ, অনেক কঠিন, অভ্যুত্থানের কারণে পারিনি। আমি এই প্ল্যাটফর্মে তো দেশ সংস্কার করতে আসছিলাম। কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতে তো আসিনি এখানে।’
জুলাই আন্দোলনের এই নেত্রী জানান, জেলা, ‘উপজেলার অনিয়মের খবর আসত শুধু, সাংবাদিকদের কল আসত। আমি পরিষ্কার করে বলেছি যারা এই কমিটিগুলো দিয়েছে তাদের আপনারা কেন জিজ্ঞেস করেন না? যাদের সাইনে কমিটি হচ্ছে তাদের মুখের সামনে মাইক ধরেন না কেন? এই কমিটিগুলো করার সময় আমার কাছে কমপ্লেইন এলে তো সরাসরি আমি অবজেকশনগুলো জানিয়েছি সাবেক আহ্বায়ক, সদস্য সচিবের কাছে। এনসিপি গঠনের আগে ঢালাওভাবে কমিটি ফর্ম হয়েছে। আমিসহ কয়েকজন এসব কমিটি নিয়ে অবজেকশন দিই। কোনো উত্তর আমাদের দেওয়া হয়নি। মুখপাত্র হিসেবে বৈষম্যবিরোধীর পেজের এক্সেস থাকার কথা আমার কাছে, আমার দায়িত্ব হওয়ার কথা মিডিয়া হ্যান্ডলিং। পেজের এক্সেস দেওয়া তো দূরের কথা এই পেজ থেকে মার্চ মাসে আমার বিরুদ্ধে পর্যন্ত পোস্ট হয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিতে চাইলে পেজকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় আর নাইলে Silent treatment সহ্য করতে হয়। দিনের পর দিন হেন কোনো নোংরামি নেই যা এরা করেনি। জুলাইয়ের পর এই পরিস্থিতিগুলো ডিল করতে গিয়ে মার্চ, এপ্রিল মাসে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাই। যাদের সাথে কাজ করতে চাচ্ছিলাম তারাও হেয়াররোডের আশায় তাকিয়ে থাকত। একদিকে আমার কথার সাথে তাল মেলাত, অন্যদিকে রাতেরবেলা হেয়ার রোডে গিয়ে পদ-পদবি নিয়ে বার্গেইনিং করত, সব খবর আমি পেতাম। আমি কনফ্রন্ট করলে আমাকেও বলা হতো যাতে সুপ্রিম অথোরিটির সাথে আমি পদ নিয়ে কথা বলে আসি। আমি সরাসরি বলি যে, আমি কেন ওদের কাছে পদ খুঁজতে যাব? ওরা আমাকে পদ দেওয়ার কে? ও কোন হনু হয়ে গেছে যে আমাকে এসে তারা পদ দিবে? ওর কাছে গিয়ে পদ আনতে হলে প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করার আর মানে কি? এসবের ভাই-ব্রাদার রাজনীতির যন্ত্রণায় বদ্ধ জলাশয়ের মতো প্ল্যাটফর্ম আটকে ছিল। আমি কাজ করতে চাইলে আমাকে করতে দিবে না। বরং পেছনে কথা ছড়ানো হতো আমি প্ল্যাটফর্মের কাউকে কাজ করতে দিচ্ছি না, কাউন্সিল আটকে রেখেছি। নেতারা তাদের জুনিয়রদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা সার্কুলেট করে বিভিন্ন ফোরামে। পরবর্তীতে আমি সিদ্ধান্ত নিই এভাবে হয় না। নির্বাহীর যারা অবশিষ্ট ছিল তাদের জানিয়ে দিই। মুখপাত্র পরিচয়টা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থী পরিচয়টাকে আপন করা শুরু করি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জানতে পারি আমি নাকি বৈষম্যের কাউন্সিল আটকে রেখেছি। অথচ সবাই জানে কাউন্সিল মন্ত্রিপাড়ায় আটকে আছে। আর আমি এই প্ল্যাটফর্মের সাথেই নেই। আমি চুপ করে ছিলাম সেটা নিয়েও একটা না একটা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছিল। আমার এত ক্ষমতা, আমি কমিটি আটকে রেখেছি। অথচ আমি শাখা কমিটি নিয়ে কোনো অ্যাকশন নিতে পারিনি, ঢালাওভাবে পেজ থেকে পোস্ট হওয়া উপজেলা কমিটিগুলোও আটকাতে পারিনি। অথচ যখন হেয়ার রোড থেকে আহ্বায়ক সিলেক্ট হলো তখন নির্বাচন হতে ২০ দিনও লাগেনি।’
উমামা ফাতেমা আরও বলেন, সর্বশেষ আসে কাউন্সিলে ভোট দিতে যাওয়ার বিষয়টি। আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাউন্সিলে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। যারা কাজ করতে চায় তারা বেশিরভাগ এই কাউন্সিলে প্রার্থীই হওয়ার সুযোগ পায়নি। ভোটার খুব লিমিটেড, যার মধ্যে একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন সব। জুনিয়ররা ক্যাম্পাসে এসে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, যাতে ভোটটা দিতে যাই। স্বাভাবিকভাবেই আমি অপারগ ছিলাম। কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার ১ মিনিট আগে আমি ভোটটা দিয়ে আসি। এতটুকুই যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি চেষ্টা করছি এখান থেকে ভালো কিছু হোক। আমি ভিতর থেকে চাচ্ছিলাম এই প্ল্যাটফর্মটার অন্তত ভালো কিছু হোক। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যেভাবে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে প্ল্যাটফর্মকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে, এখান থেকে ভালো কিছু অসম্ভব। এই নির্বাচনে কিছু প্রার্থী ছিল যাদের কাজ করার সত্যিকার ইচ্ছা ছিল। আমি ওই সাপোর্টটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে রাতেরবেলা ফলাফলের পর দেখলাম নির্বাচনে অংশ না নেওয়া একজন এসে মেম্বার হয়ে গেছে কাউন্সিলের। এসব দেখে আমি অত্যন্ত লজ্জিত। সেই একই স্বেচ্ছাচারিতা, স্ট্যান্ডবাজি, ভাই-ব্রাদার কোরামের খেলা। এখন বোধ করি এই প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
সবশেষ তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের কথা চিন্তা করে আমি এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সব ধরনের সমর্থন ও কাউন্সিলে প্রদত্ত ভোট প্রত্যাহার করলাম। আমি অত্যন্ত অশান্তিতে আছি। অভ্যুত্থান যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছে, গোষ্ঠীস্বার্থে এই প্ল্যাটফর্ম একইভাবে বহু মানুষের স্বপ্ন ও সময় নষ্ট করেছে। আমি অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিলাম। প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার আগে আমাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে যাওয়ার পরই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্রই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সবার সাথে শুধু ছলনা হয়েছে। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার সাথে নোংরামি করেছে এতগুলো মাস, অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনাবেচা করেছে তাদের আমি কখনো ক্ষমা করব না। আমি রুহের ভেতর থেকে বদদোয়া দিচ্ছি এই মোনাফেকদের। রাজনৈতিকভাবে চাইলে অনেক সুবিধা আমি নিতে পারতাম। কিন্তু পারিনি। আসেনি ভেতর থেকে। অনেক বেশি মানুষ মারা গেছে আসলে। এতগুলো সন্তান এতিম হইছে, মেয়েরা বিধবা হইছে, বাবা-মা সন্তানহারা হইছে। আমি পারি নাই এসবকে পলিটিক্যালি ক্যাশ করতে। আমি গত ৮-৯ মাসকে ঝেড়ে ফেলে সামনে এগোতে চাই। অনেক ভালো ছেলে-পেলেকে এই প্ল্যাটফর্মে আমি দেখেছি, Goodwill আছে যাদের। আমি পরামর্শ দেব আপনারা সবাই যাতে পড়ার টেবিলে মনোযোগ দেন, কাজে মনোযোগ দেন। আমিও ভেঙে পড়ছি না, গুছিয়ে আনছি সবকিছু। ফি আমানিল্লাহ
মন্তব্য করুন