কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:০৩ এএম
অনলাইন সংস্করণ

জয়-পুতুল-রাদওয়ানকে নিয়ে ‘রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেলে’ আ.লীগের নেতৃত্ব সাজাচ্ছেন হাসিনা 

জয় ও পুতুলের সঙ্গে শেখ হাসিনা, ছবি: সংগৃহীত
জয় ও পুতুলের সঙ্গে শেখ হাসিনা, ছবি: সংগৃহীত

গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সেখান থেকেই তিনি কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

শেখ হাসিনা প্রায় ৪৪ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে রয়েছেন। তার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে। এখন বর্তমানে এসে তীব্র নেতৃত্বের সংকটে পড়েছে দলটি। কারণ শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার মতো তেমন কোনো নেতা নেই। এ অবস্থায় দলটির নেতাকর্মীরা ব্যাপক নেতৃত্বহীনতা ভুগছে।

যদিও শেখ হাসিনা তার অনুপস্থিতিতে কে বা কারা কীভাবে দলের হাল ধরবেন, সেই ‘সাকসেসন প্ল্যান’ বা উত্তরাধিকারের পরিকল্পনা নিয়ে এই লম্বা ইনিংসের কোনো পর্যায়েই তিনি প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি– বা ঠিক কী ভাবছেন, তারও কোনো আভাস দেননি।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটা দলের সংগঠন যে কার্যত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল, সেটারও একটা বড় কারণ ছিল এই দুর্বলতা। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করে রেখেছে।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত সরকারের ‘অতিথি’ হিসেবে ভারতের মাটিতেই অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা – যেখানে তার গতিবিধি, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা সব ব্যাপারেই অনেক কড়াকড়ি আছে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আর খানিকটা পরিস্থিতির চাপেই তাকে এখন উত্তরাধিকারের এই অমীমাংসিত বিষয়টির ফয়সালা করার দিকে নজর দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া তার বয়সও একটা ফ্যাক্টর। কারণ চলতি মাসেই শেখ হাসিনা আটাত্তর বছর পূর্ণ করবেন।

এ অবস্থায় পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি এখানে একটা ভূমিকা থাকবে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিরও।

এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তাদের দলীয় নেতৃত্বে রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে যে ‘মডেল’ অনুসরণ করছে, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঠিক সেটাই করতে চাইছেন দলীয় সভাপতি।

গত প্রায় দুই মাস আগে দিল্লিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ‘রিজিওনাল ডিরেক্টর’ পদে ছিলেন সায়মা ওয়াজেদ, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তৃপক্ষ তাকে অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে পাঠানোর পর শেখ হাসিনার কন্যা এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন।

অন্যদিকে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ এখন মার্কিন নাগরিক ও আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা, তবে মায়ের পর দলের প্রধান মুখ ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনিই। দেশ-বিদেশের মিডিয়াকে সাক্ষাৎকারও দিচ্ছেন ঘন ঘন।

কিন্তু সায়মা ওয়াজেদ যেহেতু মায়ের সঙ্গে একই শহরে ও একই টাইম জোনে রয়েছেন, এ জন্য তিনি শেখ হাসিনাকে সরাসরি অনেকে বেশি সাহায্য করতে পারছেন। অনলাইনে মায়ের দেওয়া ভাষণের খসড়া তৈরিতে, কর্মসূচির ক্যালেন্ডার স্থির করতেও সাহায্য করছেন।

এমনকি বাইরের দর্শনার্থীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরাসরি দেখা করার ক্ষেত্রে যেহেতু অনেক বিধিনিষেধ আছে – তাই সে কাজটাও এখন অনেকাংশেই সায়মা ওয়াজেদের ওপর বর্তেছে। গত দু’মাসে তিনি বেশ কয়েকবার এরকম বৈঠকও করেছেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। শেখ হাসিনার এই তথাকথিত ‘সাকসেসন প্ল্যান’ নিয়ে ভারত ও ভারতের বাইরে অবস্থানরত বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন।

তবে এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের ভেতরে এতটাই স্পর্শকাতর একটি ইস্যু, যে তারা কেউই এটি নিয়ে ‘অন রেকর্ড’ মুখ খুলতে চাননি। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করছেন, এই বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরে এখনও কোনো আলোচনাই হয়নি।

আরাফাত বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, আপনি যে সাকসেসন প্ল্যানের কথা বলছেন সেটা এখন আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যেই পড়ে না। কে কী পদ-পদবি পেলেন, সেটা এখন ভাবারই সময় নয়।’

তিনি বলেন, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, সেই লক্ষ্যেই সব চেষ্টা নিয়োজিত করা হচ্ছে।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার পর গত মাসেই সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে আবার 'রাজনৈতিক পোস্ট' করা শুরু করেছেন – যেগুলো ছিল তার নিজস্ব কিছু মন্তব্য-সহ একটি খালাতো বোন টিউলিপ সিদ্দিকের ও অন্যটি বড় ভাই সজীব ওয়াজেদের করা পোস্টের রিটুইট।

হু-র পদে থাকাকালীন যথারীতি তাকে রাজনৈতিক মন্তব্য থেকে দূরে থাকতে হতো – কিন্তু গত কিছুদিনে তার এই সব পোস্ট থেকেই অনেকে ধারণা করছেন যে, সায়মা ওয়াজেদ হয়তো নিজেও জানেন তার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফেরার রাস্তা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

কংগ্রেসে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেলটা ঠিক কী?

বয়সজনিত কারণে ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য সোনিয়া গান্ধী যতই সক্রিয় রাজনীতি থেকে আড়ালে চলে যাচ্ছেন, ততই কংগ্রেসের নেতৃত্বের হাল ধরছেন তার ছেলেমেয়ে, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সোনিয়া গান্ধী অবশ্য এখনও রাজ্যসভার এমপি, পার্লামেন্টেও নিয়মিতই আসেন বা বিরোধী জোটের বৈঠকেও তাকে দেখা যায়।

কিন্তু দলের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, ধরনা বা সাংবাদিক বৈঠকে এখন প্রধান মুখ অবশ্যই রাহুল গান্ধী। প্রিয়াঙ্কা রয়েছেন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীর ভূমিকায়, কিন্তু তিনি বড় ভাইকে কখনো ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেননি।

অথচ বড় ভাইয়ের অনেক আগে থেকেই প্রিয়াঙ্কা রাজনীতিতে এসেছেন, সেই ১৯৯৯ থেকেই তিনি উত্তরপ্রদেশে মায়ের হয়ে নির্বাচনি প্রচারে যুক্ত থেকেছেন। কিন্তু নির্বাচন শেষে তিনি আবার প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে দূরে সরে যেতেন। আর রাহুল গান্ধী রাজনীতিতে প্রথম পা রাখেন ২০০৪ সালে, যখন আমেঠি আসন থেকে জিতে তিনি প্রথমবার লোকসভার এমপি হন। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এর তিন বছর পর।

এই মুহূর্তে রাহুল গান্ধীকে একেবারে সামনে এবং প্রিয়াঙ্কাকে ঠিক তার পেছনে রেখে যেভাবে ভারতের প্রধান বিরোধী দলটি পরিচালিত হচ্ছে – শেখ হাসিনা সেই 'মডেল'টাই আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে চাইছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

কোণঠাসা ওবায়দুল কাদের, গুরুত্ব পাচ্ছেন তিন নেতা

নিজের ছেলেমেয়েকে অঘোষিতভাবে দলের নেতৃত্বে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে আসার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ পরিচালনার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি নিজে এই মুহূর্তে ভারতের মাটিতে, দলের শীর্ষ নেতাদেরও অনেকেই এ দেশে – ফলে আওয়ামী লীগের 'নিউক্লিয়াস' এখন কার্যত প্রতিবেশী দেশের মাটিতেই।

শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ দিল্লিতে, সজীব ওয়াজেদ আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় এবং দলের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতা কলকাতায়– এভাবেই একটি ত্রিভুজাকার যৌথ নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে এই মুহূর্তে দলটির দৈনন্দিন কাজকর্ম চলছে।

কিন্তু কাগজে-কলমে এখনও যিনি আওয়ামী লগের সাধারণ সম্পাদকের পদে আছেন, সেই ওবায়দুল কাদের দলের এই নতুন কাঠামোতে একেবারেই উপেক্ষিত। প্রায় দশ মাস আগে ভারতে চলে এলেও তিনি এখনও দলীয় সভাপতির দেখাই পাননি।

শেখ হাসিনা বরং বেশি ভরসা রাখছেন দলের তিনজন নেতার ওপর – যারা প্রত্যেকেই আপাতত কলকাতায়। এরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও এক সময়ের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম এবং আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানক।

দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে তাদের সশরীরে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। তবে আপাতত তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করার কাজটি করছেন সায়মা ওয়াজেদ।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নুরের শর্টটাইম মেমোরি লস, কী বলছেন ঢামেক পরিচালক

নারায়ণগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

বাগেরহাটে ডিসিকে কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা

ইসরায়েলে হামলায় নিহত ৫, আহত ২২

বহিষ্কৃত যুবদল নেতাকে বিএনপিতে পদ দেওয়ার ৬ মাস পর অব্যাহতি

টানা বজ্রবৃষ্টি আভাস, ঝরতে পারে যেসব এলাকায়

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলকে বিজয়ী করার আহ্বান ফারুকের

পরাজয়ের আশঙ্কা থেকে একটি গোষ্ঠী সাইবার অ্যাটাক দিচ্ছে : ছাত্রদল

জার্মানি-ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলল ইরান

অফিসে না এসেও বেতন, কর্মকর্তা বললেন ‘সব কিছু সিরিয়াসলি নিতে হয় না’

১০

বাবাকে নিয়ে এবার চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন নাসুমের বোন

১১

রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী বাস চলাচল বন্ধ, ভোগান্তিতে যাত্রীরা

১২

র‍্যাবের থেকে পালাতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন শাওন, অতঃপর...

১৩

৩৩০ পদে নিয়োগ দিচ্ছে এসকেএস ফাউন্ডেশন

১৪

সন্ধ্যা ৭টার আগেই প্রতিমা বিসর্জন শেষ করতে হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৫

ডিজিটাল গ্রেপ্তারের ফাঁদে নারীরা, খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা

১৬

জাকসু স্থগিত নয়, অমর্ত্যের প্রার্থিতা নিয়ে রিট

১৭

নিজ বাসায় বিপদে অভিনেত্রী

১৮

ডাকসু নির্বাচনের দিন কেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

১৯

নিখোঁজের একদিন পর শিশুর মরদেহ মিলল খালে

২০
X