কিছুটা মেঘ কিছুটা রোদ্দুরমাখা দিনে কানাডার বৃহত্তর টরন্টোর পিকারিংয়ের পাইন রিজ সেকেন্ডারি হাই স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জমকালো উৎসব ‘বাংলা ফিয়েস্তা ২০২৫’। চার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশির প্রাণের স্পন্দনে নাচ আর গানের মূর্ছনায় উৎসবটি হয়ে উঠেছিল এক টুকরো স্বপ্নময় বাংলার জমিন। বাংলা ফিয়েস্তা টিম আয়োজিত এই উৎসবের এবারের মূল থীম ছিল ‘সংস্কৃতি, রসনা ও আনন্দের মিলনমেলা’।
২০২৪ সালে আটটি পরিবারের ঐক্যবদ্ধ পরিকল্পনা থেকে জন্ম বাংলা ফিয়েস্তা। প্রথমেই উদ্যোগটি ছিল ‘নিজেদের এলাকায় নিজের উৎসব’। স্বপ্নবাজ ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবকের প্রচেষ্টায় ২০২৫ সালে তা বাস্তবে রূপ নেয়। তারা হলেন- আশেক ইশতিয়াক হক, অটল আরিফুজ্জাহান, ফারিয়া সাহেলি, ফারিহা রহমান, ফাতেমা রত্না, হাসনাত তারেক, ইফতেখারুল মাহদী, ইশতিয়াক মাহমুদ, কামরুন্নাহার রুমা, লামিয়া তাসনিম, মোহাম্মদ আবুল কালাম বাপ্পি, নাফিজ ইমতিয়াজ, সাদেক রহমান, সালাহ উদ্দিন শৈবাল ও তামান্না সিদ্দিক। আয়োজনের পাওয়ার পার্টনার ছিল মোহাম্মদ জাকির হোসেন সরকারের রাইটস প্লাস।
গত ২৪ মে টরেন্টোর আকাশে হালকা বৃষ্টি যেন উৎসবের রঙ আরও গাঢ় করে তুলেছিল। চমৎকার এই দিনে দর্শনার্থীরা উপভোগ করেছেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, যেখানে বাংলাদেশ যেন একদিনের জন্য স্থানান্তরিত হয়েছিল টরন্টোর ডারহামের বুকে। উৎসবে বিশেষ আকর্ষণ ছিল রিকশার আদলে সাজানো ফটো বুথ, যা দর্শনার্থীদের জন্য হয়ে উঠেছিল স্মৃতির এক আলোকচিত্র। ছোটদের ফটো বুথে ছিলো তাদের প্রিয় সব কার্টুন চরিত্র। বই পড়ুয়া আর আড্ডাবাজদের জন্যে ছিল আড্ডা কর্ণার। বাকের ভাই-বদি থেকে শুরু করে, চে আড্ডাবাজদের জন্যে সব রসদ জড়ো ছিল সেখানে।
শিশু-কিশোরদের জন্য ছিলো চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গান ও নাচের প্রাণবন্ত আয়োজন। অর্ধশতাধিক শিশু কিশোর এ আয়োজনে অংশ নেয়; যেখানে তাদের সৃজনশীলতা ও আত্মপ্রকাশের সুযোগে তৈরি হয় এক আনন্দঘন পরিবেশে। প্রবাসে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা সংস্কৃতির সেতুবন্ধন তৈরির যে পরম্পরা তা যেন ফুটে উঠেছিল প্রতিটি পরিবেশনায়।
বড়দের জন্য আয়োজনটি ছিল আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। মঞ্চ কাঁপিয়েছেন টরন্টোর জনপ্রিয় শিল্পীরা। শমিত বড়ুয়া, শিরিন চৌধুরী, আফরিনা হাশিম, ফারিয়া শ্বেতা, ফারহানা মিতা, সাঈদ রহমান, সারাফ, শাহরিয়ার রনি, জেসমিন কাজী, এডওয়ার্ড মিল্টন, ডাক্তার আনিস, আবদুল্লাহ আল মাহমুদসহ আরো অনেকের গানের আবেশে দর্শক শ্রোতারা হয়েছিলেন মন্ত্রমুগ্ধ।
দোতারা বাদক জুনায়েদ আনোয়ার চয়নের উপস্থাপনায় ছিল মাটির ঘ্রাণ। কবিতায়, কথায় ও গানে প্রাণ জুগিয়েছে ঐতিহ্যবাহী আবৃত্তি সংগঠন ‘অন্যস্বর’।
দর্শকদের হৃদয় জয় করেছে ইত্তেলা উমামার নির্দেশনায় ‘আই এম ক্রিয়েটিভ’ গ্রুপের নাচ ও ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা পরিবেশনা। পুতুল নাচ, বানর নাচ, সাপের খেলা যেন আবহমান গ্রাম বাংলার মেলার আবহ তৈরি করেছিল। পাহাড়ি অঞ্চলের খন্ড নৃত্য তুলে ধরা হয় পাহাড়ের রোমান্স, প্রেম ও আবেগ।
ডাকাতিয়া বাঁশির পরিবেশনায় ছিল বাংলা গ্রামের ঐতিহ্য ও বহুরূপীর চটুল বিনোদন। শেষ আকর্ষণ ছিল টরন্টোর বিখ্যাত ব্যান্ড ‘যান্ত্রিক’। সব যান্ত্রিকতা মুছে দিয়ে বাংলার রক, পপ-এর মূর্ছনায় মাতিয়ে তুলেছিল হলভর্তি দর্শকদের। নাচ-গানের মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশ-বাতাস, প্রেম-বিরহ, আর প্রতিবাদের ধ্বনি ভেসে এসেছে পাইন রিজের মঞ্চে।
অন্যদিকে, বিপণন স্টলগুলো ছিল জমজমাট! চল্লিশের অধিক স্টলে সাজানো ছিল দেশীয় হস্তশিল্প, পোশাক ও মজাদার খাবারের পশরা। মুড়ি মাখা থেকে শুরু করে আম-ভর্তা, ফুচকা, চটপটি, মিষ্টি সবকিছুতেই ছিল ঘরের স্বাদ। উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন সিটি কাউন্সিলর মারা নাগী ও শাহীন ভট্ট।
আয়োজকরা বলেন, এই আয়োজন প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে আমাদের শিকড়, সংস্কৃতি আর পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত রাখার এক নিবেদিত প্রয়াস। দর্শকদের অভূতপূর্ব সাড়া এবং সাংস্কৃতিক মিলনে এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় দিন। বাংলা ফিয়েস্তা শুধু একটা উৎসব নয়, একটা অনুভূতি ও ঐতিহ্যের জয়গান।
মন্তব্য করুন