পৃথিবীর গভীরে লুকিয়ে আছে তার শুরুর গল্প। সেই গল্প কখনো আগুনের, কখনো বরফের, কখনো বা বিস্ময়ের। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এমন এক শিলার সন্ধান পেয়েছেন, যা আমাদের গ্রহের ইতিহাসের প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক রহস্যঘেরা অধ্যায়ের গল্প বললেও বলতে পারে।
সিএনএন-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তর কানাডার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কুইবেকের পূর্ব প্রান্তে হাডসন উপসাগরের কোলে নির্জন এক পাথরের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে লাখো বছর ধরে। এই অঞ্চলকে বলা হয় ‘নুভুভাগিটুক গ্রিনস্টোন বেল্ট’। বাইরে থেকে এটি সাধারণ পাহাড়ের মতোই, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর আদিমতম স্মৃতি- এমনটাই বলছেন বিজ্ঞানীরা।
শুরুর এক ঝলক: হাডিয়ান যুগ
আমাদের পৃথিবী জন্ম নিয়েছিল প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে। সেই সময় ছিল অগ্নিময়, উত্তপ্ত, ধ্বংসাত্মক। যেন এক আগুনের গ্রহ। এই প্রাচীন সময়কে বলা হয় হাডিয়ান যুগ। তখন পৃথিবীর ভূত্বক ছিল অস্থির, স্থায়ী কিছুই ছিল না। আর ঠিক সেই যুগ থেকেই এসেছে এই শিলা। বিজ্ঞানীদের মতে, যার বয়স ৪১৬ কোটি বছর!
এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ভূবিজ্ঞানী জনাথন ও’নিল। তিনি বলেন, ‘শিলাগুলো ভূবিজ্ঞানীদের কাছে একটি বইয়ের মতো। এর প্রতিটি স্তর আমাদের ইতিহাস বলে। নুভুভাগিটুক গ্রিনস্টোন বেল্ট যেন সেই বইয়ের হারিয়ে যাওয়া প্রথম অধ্যায়েরই একটি পৃষ্ঠা।’
বয়স জানার রহস্যময় ঘড়ি
এমন প্রাচীন শিলার বয়স কীভাবে নির্ধারণ করা হয়? বিজ্ঞানীরা সাধারণত বিকিরণভিত্তিক সময় নির্ধারণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। একটি তেজস্ক্রিয় উপাদান কেমন করে আরেকটিতে রূপান্তর হয় সেটাই এক ধরনের ‘প্রাকৃতিক ঘড়ি’ হিসেবে কাজ করে।
সাধারণত ‘জারকন’ নামক খনিজ ব্যবহার করে শিলার বয়স নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের শিলায় জারকন নেই। তাই ও’নিল ও তার দল ভরসা করেছেন স্যামারিয়াম এবং নিওডিমিয়াম নামক দুই বিরল উপাদানের ওপর। এদের সাহায্যে আগে উল্কাপিণ্ডের বয়স নির্ধারণ করা হতো।
গবেষণার দুটি আলাদা ঘড়ি শিলাটির একই বয়স দেখিয়েছে—৪১৬ কোটি বছর। এই তথ্য এই শিলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ভূত্বকের দাবিদার করে তুলেছে।
শুধু শিলা নয়, জীবনের ইঙ্গিতও
এই অঞ্চলে শুধু প্রাচীন শিলা নয়, পাওয়া গেছে জীবনের আদিম চিহ্নও। যেমন ব্যাকটেরিয়ার তৈরি সুতা আকৃতির জীবাশ্ম। এটি ইঙ্গিত দেয়, এই শিলার মধ্যে হয়তো পৃথিবীতে জীবনের প্রথম আলো ফোটার সাক্ষীও লুকিয়ে আছে।
তবে সব বিজ্ঞানী এখনো এ বিষয়ে একমত নন। কেউ কেউ মনে করেন, শিলার সব খনিজ এক বয়সের নাও হতে পারে। তাই পুরো শিলার বয়স নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তবুও এ নতুন গবেষণা আগের থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
যত দূরেই হোক, যত পুরোনোই হোক, একটি শিলা আমাদের শোনাতে পারে পৃথিবীর জন্মের গান। সেই শিলার ভাষা বুঝতে পারাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বড় সাফল্য। নুভুভাগিটুক গ্রিনস্টোন বেল্ট হয়তো আমাদের শোনাবে সেই প্রথম শব্দ—যখন পৃথিবী বলেছিল, ‘আমি আছি।’
মন্তব্য করুন