নামে ‘ফেয়ার’ হলেও কাজকর্মে ন্যায্য ও স্পষ্টতা দেখা যাচ্ছে না প্রযুক্তি পণ্য নির্মাণ এবং বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার গ্রুপে। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার পুটিয়া ইউনিয়নের কামারগাঁও মৌজায় অবস্থিত ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের কারখানা। ফেয়ার গ্রুপের এ প্রতিষ্ঠানটির জমির একাংশের মালিকানা নিয়ে চলছে মামলা। কিন্তু সেই বিবদমান জমিতে অবস্থিত স্থাপনাকে ‘বেসরকারি হাইটেক পার্ক’ হিসেবে ঘোষণা পাওয়ার চেষ্টা করছে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স। কর রেয়াতসহ অন্তত ১৪ ধরনের সরকারি সুবিধা পেতে তথ্য গোপন করে ওই জমিতেই হাইটেক পার্ক ঘোষণা পেতে এরই মধ্যে আবেদন করেছে। অভিযোগ আছে, জমির একাধিক অংশ জোর করে দখল করেছেন ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের স্বত্বাধিকারী রুহুল আলম আল মাহবুব।
প্রযুক্তি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা ও প্রণোদনা দিয়ে এ খাতের স্থাপনাকে তিনটি শ্রেণিতে ঘোষণা দিতে পারে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এগুলো হলো সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, মিনি হাইটেক পার্ক ও হাইটেক পার্ক। সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের স্থাপনাকেও এসব শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। শ্রেণিভেদে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং সেসব স্থাপনায় থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আয়করের ওপর রেয়াত, কাঁচামাল ও স্থাপনা নির্মাণে করবিহীন পণ্য আমদানি, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি, রপ্তানির ওপর প্রণোদনার মতো অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। তাই এসব শ্রেণিভুক্ত হতে বরাবরই আগ্রহী থাকে খাত সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এবং সাতটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি হাইটেক পার্ক হিসেবে ঘোষণা পেয়েছে। এর মধ্যে ‘বেসরকারি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ এর তালিকায় ১১ নম্বরে রয়েছে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স।
এমনই প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালে ১৭.২২ একর জমিতে নিজেদের স্থাপনাকে বেসরকারি হাইটেক পার্ক হিসেবে ঘোষণা পেতে আবেদন করে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স। বর্তমানে নিজেদের কারখানায় মোবাইল ফোন ও ট্যাবলেটের মতো টেলিযোগাযোগ পণ্য, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, টেলিভিশন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ও
ওয়াশিং মেশিন উৎপাদন করছে ফেয়ার। দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক স্যামসাংয়ের বাংলাদেশের পরিবেশকও ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স। বেসরকারি হাইটেক পার্ক হিসেবে ঘোষিত হলে অন্তত ১৪টি সুবিধা পাবে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স, যেগুলো তাদের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে দেবে। সুবিধাগুলো হলো—আয়কর রেয়াত, হাইটেক পার্ক নির্মাণ ও পার্কে উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানিতে (নির্দিষ্ট পণ্যে) শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর
(মূসক) অব্যাহতি, রপ্তানিতে প্রণোদনা, শুল্কমুক্ত বন্ডেড সুবিধা, বিদেশি কর্মীর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কর অব্যাহতি, মালিকানায় বিদেশি অংশীজন থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্ট খোলা, সেই অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা ও শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি ইত্যাদি। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আইসিটি খাত সংশ্লিষ্ট এক ব্যবসায়ী জানান, এসব সুবিধায় ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের মতো বৃহৎ আকারের প্রতিষ্ঠানের বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে।
বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ বিধিমালা, ২০১৫-এর বিধি ৪(২) অনুযায়ী, স্থাপনাকে হাইটেক পার্ক ঘোষণা করার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আপত্তি জানানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য ঘোষণার আগে দেশের বহুল প্রচলিত জাতীয় দৈনিকে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি আবেদনকারীকে হলফনামায় উল্লেখ করতে হয় যে, তার স্থাপনার জমি নিষ্কণ্টক। গত বছরের ১৭ জুলাই হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স প্রসঙ্গে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিধি অনুযায়ী, গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ২১ দিনের মধ্যে কারও আপত্তি থাকলে সেটি কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাঁচ দিন পরই অর্থাৎ ২০২২ সালের ২২ জুলাই পুটিয়ার বাসিন্দা খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সকে হাইটেক ঘোষণা না করার দাবি জানিয়ে আবেদন করেন। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়েরও আর্জি জানান ওই ব্যক্তি। আবেদনের একটি কপি রয়েছে কালবেলার কাছে।
আবেদনে জাহাঙ্গীর উল্লেখ করেন, ‘আমি ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের কাছে ১২.৫ শতাংশ জমির মূল্য পাই এবং ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স আমার থেকে জমি রেজিস্ট্রি না করে বেনামে জমি রেজিস্ট্রি করে ভোগ দখল করিতেছে। বহুবার চেষ্টা করেও ওই পাওনা আদায় করতে না পেরে নরসিংদীর শিবপুর সহকারী জজ আদালতে ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই মামলা দায়ের করেছি। দেওয়ানি মামলা নং ৪৯/২০১৮।’ অর্থাৎ নিজেদের জমি নিষ্কণ্টক না বা বিবদমান জেনেও হলফনামা দাখিল করার অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
জাহাঙ্গীর আলমের আবেদনের সূত্র ধরে যোগাযোগ করা হলে কালবেলাকে তিনি বলেন, ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স যে জায়গায় কারখানা করেছে তার মধ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশ জমির মালিক আমার বাবা খন্দকার সামসুল ইসলাম। বাবার মৃত্যুর পর তিন ভাই ও দুই বোন এই জমির মালিক হই। দুই বোন এবং এক ভাইয়ের কাছ থেকে তারা ঠিকমতোই জমি কিনে নেয়। কিন্তু আমার ও আরেক ভাইয়ের জমি তারা জোর করে দখল করে। বিষয়টি জেনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ২০১৬ সাল থেকে হয়রানি করছে ফেয়ারের মালিক রুহুল আলম আল মাহবুব। ওই সময় তিনি জমির মূল্য পরিশোধ করবেন বলে জানালেও সময় চেয়েছিলেন, তাই জমির মূল্য নির্ধারণ হয়নি। তখন প্রতি শতাংশ জমির বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫ লাখ টাকা। কিন্তু এখনো আমরা জমির দাম পাইনি। বর্তমানে সেই জমির দাম কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা। সে হিসাবে ১২.৫ শতাংশের দাম আসে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আরও অনেকের জমি দখল করে ব্যাংক লোন নিয়ে কারখানা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফেয়ারের মালিক মাহবুব আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে বলে স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগকারী জাহাঙ্গীর আরও বলেন, গত বছরের নভেম্বরে আমাকে এবং ফেয়ার কর্তৃপক্ষকে শুনানির জন্য হাইটেক পার্ক দপ্তরে ডাকা হয়। আমি গেলেও তারা যায়নি। পরে ডিসেম্বরে আবারও একটি বৈঠক হয়। সেখানেও জমির মূল্য পরিশোধ করার কথা জানান ফেয়ারের প্রতিনিধি। হাইটেক পার্কের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকর্ন কুমারও বিষয়টি জানতেন। দুদিন পর ফেয়ার তাদের আইনজীবীদের নিয়ে সেখানে আরেকটি মিটিং করে। এরপর থেকে আর তাদের কোনো খবর নেই। এর মধ্যে জানতে পারি, মীমাংসা না করেই গোপনে হাইটেক পার্ক ঘোষণার চেষ্টা করেই যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য গত ২১ মে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের এমডি, অর্থ ও প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এবং প্রকিউরমেন্ট বিভাগের উপপরিচালককে পক্ষ করে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাই। তবে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে হাইটেক পার্কের বর্তমান এমডি রেজাউল করিম মোবাইল ফোনে কালবেলাকে বলেন, যতটুকু মনে পড়ছে, বিষয়টিতে দুপক্ষের মধ্যে কোনো মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি। তাই এ সম্পর্কে মতামত চেয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রতিবেদকের পরিচয় ও যোগাযোগের কারণ লিখে খুদেবার্তা দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির কমিউনিকেশন্স বিভাগে যোগাযোগ করা হলে ফেয়ার গ্রুপের চিফ মার্কেটিং অফিসার মেসবাহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। মেসবাহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সম্পত্তি বিভাগ থেকে জেনে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন বলে প্রতিবেদককে জানান। এরপর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় অপেক্ষা করলেও আর যোগাযোগ করেননি মেসবাহ উদ্দিন। সাড়া দেননি প্রতিবেদকের ফোন ও খুদেবার্তারও।
মন্তব্য করুন