ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসে বেশ কয়েকবার ভাবতে হলো। কিন্তু ভাবাটাই সারা হলো শেষ পর্যন্ত। ‘কী নামে ডেকে বলব তোমাকে’ গানে শ্যামল মিত্রের যে অবস্থা হয়েছিল, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ব্যাটিং দেখার পর যে কোনো দর্শক মাত্রই যে এমন দ্বিধান্বিত-বিহ্বল হয়ে পড়েছেন, তা বলাই বাহুল্য।
বিশ্বকাপের প্রথম কয়েকটি ম্যাচ খেলার পর চোটে পড়েছিলেন ম্যাক্সওয়েল। আজকের ম্যাচ দিয়ে আবার বাইশ গজে ফিরে এসেছেন তিনি। কিন্তু সেই ফেরাটাই যে এত রাজসিক, এত স্মরণীয় হবে, তা-ই বা কে জানত।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দর্শকরা আজকে যে ম্যাচ উপভোগ করলেন, তার তুলনা চলে কেবল কৌরব ও পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্রের সঙ্গেই। অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নামিয়ে আনার গৌরব লাভের আশা নিয়েই ম্যাচ শুরু করেছিল আফগানরা। নিজেদের ব্যাটিং শেষ করার পর বোলিংয়ে এসে যেন আগুনের গোলা ছুড়ছিলেন প্রতিপক্ষের সৈন্যদের দিকে। একে একে সাতজনকে বিদায় করার পর অস্ট্রেলিয়া বধের অহংকারই পেয়ে বসেছিল গুরবাজ-রশিদ খানদের। আর শেষ পর্যন্ত সেই অহংকারই পতন ডেকে আনল আফগানদের।
খেলার শুরুতে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ২৯১ রান তুলেছে আফগানিস্তান। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ১২৯ রান করেছেন ইব্রাহিম জাদরান। অজিদের হয়ে ৩৯ রানে ২ উইকেট শিকার করেছেন জশ হ্যাজেলউড।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে দলীয় মাত্র ৯১ রানেই সাত উইকেট খুইয়ে বসে অস্ট্রেলিয়ানরা। আফগানদের তোপের মুখে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একে একে বিদায় নিয়েছেন ওয়ার্নার, মার্শ, ট্রাভিসের মতো সেনাপতিরা। ঠিক যখনই স্বর্গ থেকে পতনের শঙ্কায় অজি সাম্রাজ্য, তখনই মাঠে নেমে যুদ্ধের পতাকা উঁচিয়ে ধরলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
এর পরের ইতিহাস ম্যাক্সওয়েলের নিজের হাতেই লেখা। অবশ্য 'হাত' না বলে ব্যাট বলা উচিত। দুই ফুটের ওই ব্যাটটাকে নিয়ে আফগান বোলারদের সঙ্গে যে ছেলেখেলা খেললেন তিনি, তার সঙ্গে যেন কোনো বিশেষণই চলে না আসলে। ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংসের মাধ্যমে যেভাবে দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছেন এই অজি ব্যাটার, তার বর্ণনা দিতে গেলে আরেকটি মহাকাব্য রচিত হবে নিশ্চিত।
আফগানদের ২৯২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে শুরুতেই ট্রাভিস হেডকে হারায় অস্ট্রেলিয়া। শূন্য রানে সাজঘরে ফিরেছেন এই ওপেনার। তিনে নেমে ঝোড়ো ব্যাটিং শুরু করেন মিচেল মার্শ। তবে খুব বেশি দূর যেতে পারেননি। নাভিনের বলে লেগবিফোরের ফাঁদে পড়ার আগে ১১ বলে করেছেন মাত্র ২৪ রান। দিল্লি তখনো বহুত দূরই বলা চলে।
এরপর পালা আসে ডেভিড ওয়ার্নারের। পরীক্ষিত এই সৈনিকও ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন মাত্র ১৮ রান করে। সময় নিয়ে থিতু হয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি তিনি। এরপর দুই অঙ্ক ছোঁয়ার আগেই হার মেনেছেন মার্কাস স্টইনিশ-জশ ইংলিশরাও।
তারপরের পালা ছিল ম্যাক্সওয়েলের। অষ্টম উইকেটে কামিন্সকে সঙ্গে নিয়ে ২০২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন তিনি। যেখানে মাত্র ১২ রান এসেছে কামিন্সের ব্যাট থেকে। বাকিটা একাই সামাল দিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল। অবিশ্বাস্য এই ইনিংসও খেলেছেন আবার হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে।
ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসের মাহাত্ম্য টের পাওয়া যাবে তার বাউন্ডারির সংখ্যা দেখলেই। ২০১ রানের ইনিংস খেলতে গিয়ে ১০ ছয় ও ২১টি চারে ১৪৪ রান করেছেন কেবল ৩১ বল থেকে। ব্যক্তিগত রানের তিন অঙ্ক ছুঁতে ম্যাক্সওয়েল খরচ করেছেন ৭৬ বল। এরপর ১৫০ রানের মাইলফলকে পৌঁছেছেন ১০৪ বলে। সময় যত গড়িয়েছে ততই বিধ্বংসী হয়ে উঠেছেন তিনি। ১৫০ থেকে ডাবল সেঞ্চুরিতে পৌঁছাতে খেলেছেন মাত্র ২৪ বল। সবমিলিয়ে ১২৮ বলে নিজের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির স্বাদ নিয়েছেন তিনি।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করল অস্ট্রেলিয়া।
মন্তব্য করুন