মুজাহিদুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:১৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশে ঘটতে যাচ্ছে আরেক ‘জুলাই বিপ্লব’?

জাকার্তার রাস্তায় পতাকা হাতে হাঁটছেন বিক্ষোভকারী এক তরুণ। ছবি : সংগৃহীত
জাকার্তার রাস্তায় পতাকা হাতে হাঁটছেন বিক্ষোভকারী এক তরুণ। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় চলমান বিক্ষোভ ক্রমশ নতুন মাত্রা নিচ্ছে। রাজধানী জাকার্তাসহ বড় শহরগুলোতে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে, সরকারি কার্যালয়গুলোর সামনে অবস্থান নিচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও দাঙ্গার রূপও নিচ্ছে এই প্রতিবাদ। আন্দোলনের ধরন ও বিস্তৃতি দেখে অনেকেই একে বাংলাদেশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে তুলনা টানছেন। প্রশ্ন উঠছে— ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভকারীরা কি আদতে সেই অভিজ্ঞতাকে অনুকরণ করছে?

বিক্ষোভের সূচনা ও বিস্তার

ঘটনার সূত্রপাত হয় সংসদ সদস্যদের জন্য অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়ার ভাতা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। তথ্য ফাঁসের পর জানা যায়, একজন আইনপ্রণেতা মাসে ৫০ মিলিয়ন রুপিয়া বা প্রায় তিন হাজার মার্কিন ডলার পাবেন, যা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ন্যূনতম মজুরির দশ গুণেরও বেশি। এই বৈষম্য প্রকাশ্যে আসতেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে ছোট ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই রাস্তায় নেমে আসে।

অল্প সময়েই আন্দোলন শুধু অর্থনৈতিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পুলিশি নিপীড়ন, রাজনৈতিক অদক্ষতা, দুর্নীতি আর বেকারত্বের মতো দীর্ঘদিনের জমে থাকা অসন্তোষও যুক্ত হয়েছে এতে। ফলে বিক্ষোভ দেশব্যাপী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

একটি হত্যাকাণ্ডে আগুনে ঘি

২৮ আগস্ট ২১ বছর বয়সী খাবার ডেলিভারি কর্মী আফ্ফান কুরনিয়াওয়ান পুলিশের গাড়িচাপায় নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ব্রিমব নামে পরিচিত বিশেষ বাহিনীর একটি গাড়ি ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ধাক্কা দেয়। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। মানুষের ক্ষোভ তীব্র হয়, পুলিশের প্রতি ঘৃণা আকাশচুম্বী রূপ নেয়। এর পর থেকে আন্দোলনের সাথে মানুষের আবেগের এক গভীর যোগ তৈরি হয়, যা আন্দোলনকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।

সংগঠনের ধরন : নেতৃত্বহীন ও বিকেন্দ্রীভূত

এ আন্দোলনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর নেতৃত্বহীন চরিত্র। কোনো দল বা বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে এখানে দেখা যাচ্ছে না। বরং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সমাবেশ করছে, শ্রমিক সংগঠনগুলো আলাদা মিছিল করছে, আবার নাগরিক সমাজের কর্মীরাও পৃথক কর্মসূচি দিচ্ছেন। সব একসূত্রে বাঁধা আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

ফেসবুক, এক্স ও টিকটকে প্রচুর ভিডিও, পোস্ট ও লাইভ সম্প্রচার আন্দোলনকে এক নতুন ধারা দিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা টেলিগ্রাম চ্যানেলে পরিকল্পনা হচ্ছে পরবর্তী দিনের অবস্থান কর্মসূচির। অনেকটা ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের মতোই, যেখানে নেতৃত্ব ছিল ছত্রভঙ্গ, কিন্তু তরুণদের সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর সমন্বয়ই আন্দোলনের প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ও অনুকরণের প্রশ্ন

বাংলাদেশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান মূলত একটি যুব-নেতৃত্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত এবং একক নেতৃত্বহীন আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক, কৃষক, এমনকি সাধারণ মানুষও একাত্ম হয়েছিল। ফলে দমননীতি ব্যর্থ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার আন্দোলনেও একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মই মূল চালিকাশক্তি, সঙ্গে আছে শ্রমজীবী মানুষ। পুলিশের সহিংসতা ও সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ আন্দোলনকে আরও উস্কে দিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে ইন্দোনেশিয়ার তরুণরা বুঝতে পেরেছে যে, স্বতঃস্ফূর্ত জনআন্দোলনও রাষ্ট্রক্ষমতাকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। যদিও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে এখনো সরকার পতনের সুস্পষ্ট লক্ষ্য দৃশ্যমান নয়, তবে রাজনৈতিক সংস্কার ও দায়বদ্ধতার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া

প্রেসিডেন্ট প্রাবোও আন্দোলনকে ‘অরাজকতার প্রচেষ্টা’ আখ্যা দিয়ে সেনা ও পুলিশ মোতায়েন করেছেন। অনেক জায়গায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। শত শত মানুষকে আটক করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই তরুণ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এটিকে গণগ্রেপ্তার ও দমননীতি হিসেবে অভিহিত করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্বেগ বাড়ছে। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন সংস্থা বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।

বিক্ষোভকারীদের দাবিগুলো

আন্দোলনকারীরা শুধু এমপিদের ভাতা বাতিলই চান না, তারা পুলিশের দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, এবং রাজনৈতিক সংস্কারেরও দাবি জানাচ্ছেন। “১৭+৮” নামে একটি কাঠামোতে তারা সংস্কার পরিকল্পনা সাজিয়েছে— যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ, বেকারত্ব কমানো এবং দুর্নীতি দমন।

সম্ভাব্য পরিণতি

পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এটি হয়তো ১৯৯৮ সালের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে এগোতে পারে, যখন সুহার্তোর দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটেছিল। আবার অনেকের মতে, আন্দোলন এখনো মূলত সংস্কারকেন্দ্রিক এবং সরকার চাইলে কিছু ছাড় দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।

পরিশেষে

ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান আন্দোলন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনি বহন করছে। দুটির মধ্যে মিল হলো নেতৃত্বহীন চরিত্র, যুবসমাজের অগ্রণী ভূমিকা এবং দমননীতির বিরুদ্ধে জনঅভ্যুত্থান। পার্থক্য হলো, বাংলাদেশের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরাসরি শাসক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছে, কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভ এখনো সংস্কার দাবি নিয়েই চলছে।

তবে যদি সরকারের দমননীতি চলতেই থাকে এবং আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয়, তাহলে হয়তো ইন্দোনেশিয়াও তাদের নিজস্ব এক “জুলাই গণঅভ্যুত্থান”-এর দিকে এগোতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চটকধার বিজ্ঞাপন দেখে পার্লারে আসেন নারীরা, অতঃপর...

চবিতে বঙ্গবন্ধু চেয়ারে মুনতাসীর মামুনের নিয়োগ বাতিল, টাকা ফেরতের নির্দেশ

পুত্র সন্তানের বাবা হলেন তপু খান 

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে পাকিস্তান আইএসপিআরের বিবৃতি

ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিল ‘মেলিসা’, ধেয়ে আসছে ২৬০ কিমি বেগে

একাত্তরকে সম্পত্তি বানিয়ে রাজনৈতিক শিল্পে পরিণত করেছে আ.লীগ : শিবির সভাপতি

মেট্রোরেলের গতি কমল

আফ্রিকার এক দেশে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা

আগামীকাল বিদ্যুৎ থাকবে না জানিয়ে বার্তা

জামালপুরে জেলা ও দায়রা জজের আদালত বর্জন আইনজীবীদের

১০

প্রস্রাবের পর শুধু টিস্যু ব্যবহার করলে নামাজ হবে?

১১

শতবর্ষে নিভে গেল অভিনেত্রীর জীবনপ্রদীপ

১২

খুমেকে সাংবাদিকের ওপর হামলা, প্রাণনাশের হুমকি

১৩

আসছে আমার নতুন অ্যালবাম ‘ভাল্লাগে না’

১৪

জাপানে ১ লাখ দক্ষ কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া জানাল প্রতিনিধি দল

১৫

ড্যাফোডিল-সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ, সর্বশেষ যা জানা গেল

১৬

ঢাবির হলে ধূমপানে ৩০০ টাকা জরিমানা, গাঁজা সেবন করলে বহিষ্কার 

১৭

বরিশাল-খুলনা ম্যাচ চলাকালে মারা গেলেন ফিজিও

১৮

কাভার্ডভ্যান চাপায় ইজিবাইকের ৪ যাত্রী নিহত

১৯

আরও অর্ধশত ভারতীয়কে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

২০
X