মুসলিমদের ওপর ইসরায়েলের দমন-পীড়নের ইতিহাস নতুন নয়। এ অত্যাচার তারা চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরেই। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তা আরও উন্মোচিত হয়েছে। দমন‑পীড়নের এই ধারাবাহিকতা এখন শুধু ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ‑আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এর ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার, মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা—সবই প্রশ্নের মুখে।
ইসরায়েল যখনই সুযোগ পেয়েছে মুসলিমদের স্বার্থের ওপর আঘাত হেনেছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা যেখানেই মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে সেখানেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের থামাতে উঠেপড়ে লেগেছে ইসরায়েল। এমনকি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালাতেও দ্বিধা করেনি তারা। সম্প্রতি গাজায় গণহত্যা থেকে শুরু করে ইরানে হামলা আমাদের ইসরায়েলের সেই এজেন্ডাই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
ইরানে সামরিক অভিযান: ‘নিরাপত্তা’র নামে নিধন
ইরানের নাতানজ, ইসফাহান ও আরাকের মতো পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের ১৩ জুনের ‘অপারেশনাল হামলা’ উত্তেজনাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। প্রায় ২০০টি ফাইটার জেট ব্যবহার করে চালানো এই অভিযানে ৬০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু এবং প্রায় ১,৩০০ জনের আহত হওয়া ইসরায়েলি সামরিক পরিকল্পনার নিষ্ঠুর দিকটাই তুলে ধরে। এই আক্রমণ শুধু ইরানের সামরিক পরিকাঠামো নয়, বেসামরিক জনগণের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
ইসরায়েল বলছে, তারা ইরানের পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি থামাতেই এসব অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র লক্ষ্য করলেও প্রাথমিক আঘাত এসে পড়ে হাসপাতাল, গবেষণাগার, এমনকি আবাসিক এলাকায়। এতে বোঝা যায়, ‘সামরিক অভিযান’-এর আড়ালে রয়েছে মুসলিমপ্রধান একটি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে তোলার সুস্পষ্ট কৌশল।
ফিলিস্তিনে মানবিক বিপর্যয়
গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন শুধু আরেকটি সীমান্ত দ্বন্দ্ব নয়, এটি একটি মানবিক সংকট। নির্বিচারে গ্রেনেড, ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা বর্ষণের ফলে নিহত হচ্ছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। মসজিদ, হাসপাতাল, স্কুল—সবই হামলার আওতায় পড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত সতর্ক করলেও বাস্তবে পরিবর্তন নেই। বরং, ইসরায়েলের দমননীতিকে বৈধতা দিতে পশ্চিমা দেশের নীরবতা এই হত্যাযজ্ঞকে আরও উৎসাহিত করছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে মুসলিম নাগরিকদের অবস্থা
এমনকি ইসরায়েলের ভেতরে বসবাসরত মুসলিম নাগরিকরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। হাইফা, তামরা, আরবা, লদসহ মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলোতে নেই আশ্রয়কেন্দ্র বা জরুরি সেবা। ‘একই দেশের নাগরিক’ হয়েও তাদের প্রতি সরকারের অবহেলা স্পষ্ট। হাইফার একটি মসজিদে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার ঘটনায় কাঠামোগত ক্ষতি কম হলেও ধর্মীয় অনুভূতিতে ছিল বড় ধাক্কা। এই বৈষম্য কেবল সামাজিক নয়, রাজনৈতিকও, যা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভেতরেই প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য প্রমাণ করে।
লেবাননের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও হিজবুল্লাহ প্রসঙ্গ
লেবাননের সঙ্গে ইসরায়েলের বহু পুরোনো দ্বন্দ্ব আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে হিজবুল্লাহকে ঘিরে। ২০০৬ সালের যুদ্ধের জের আজও রয়ে গেছে সীমান্তে। গাজা যুদ্ধের পর নতুন করে রকেট ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহ, পাল্টা আক্রমণ করছে ইসরায়েলও। এতে সীমান্তের হাজারো সাধারণ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। এই সংঘাতে ইরান-হিজবুল্লাহ সম্পর্ক যুক্ত হয়ে ইসরায়েলের মুসলিমবিরোধী যুদ্ধকে আরও আঞ্চলিক রূপ দিয়েছে।
বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র ও ইসলামভীতি
ইসরায়েল কেবল সামরিক নয়, তথ্যপ্রযুক্তির হাতিয়ারে বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে গোয়েন্দা তৎপরতা, নজরদারি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। পশ্চিমা দেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব ছড়িয়ে ইসলামভীতির (ইসলামোফোবিয়া) সংস্কৃতি তৈরি করছে। এটি মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ—যার লক্ষ্য মুসলিম সমাজকে ভেতর থেকে দুর্বল করা।
ধর্মীয় অনুভূতির ওপর হামলা
ইসরায়েলি নীতির আরেকটি দিক হলো ধর্মীয় অনুভূতির ওপর সুপরিকল্পিত আঘাত। মসজিদে হামলা, কোরআন অবমাননা, পোশাক নিয়ে বিদ্রুপ—এসব ঘটনা মুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অবমাননা নয়; বরং বৈশ্বিক ধর্মীয় সহনশীলতার ওপর হুমকি।
মুসলিম দেশগুলোতে ‘টার্গেটেড কিলিং’
ইসরায়েল বর্তমানে ‘টার্গেটেড কিলিং’ বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করার নীতিতে বিশ্বাস করছে। হামাস, ইসলামিক জিহাদ, হিজবুল্লাহ, আইআরজিসি—এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহেই অনেককে হত্যা করা হচ্ছে। কিছু মানুষ ছিলেন সাংবাদিক, কেউ গবেষক, যাদের বিরুদ্ধে বিচার ছাড়াই প্রাণহানি ঘটছে। এতে আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিমালাই ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
পরিশেষে, ইসরায়েল বর্তমানে কেবল একটি রাষ্ট্র নয়; বরং একটি কৌশলগত ব্যবস্থা—যার কেন্দ্রে রয়েছে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দুর্বল করা। এটি সামরিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় সব মাত্রাতেই সক্রিয়। মুসলিম বিশ্বের সামনে এখন বড় প্রশ্ন—এই নিপীড়নকে কীভাবে প্রতিহত করা যায়? কূটনৈতিকভাবে? সামরিকভাবে? নাকি ঐক্যের ভিত্তিতে?
যে বাস্তবতায় ঘরে-বাইরে মুসলিমরা একে একে ইসরায়েলের নিশানা হয়ে উঠছে, সে বাস্তবতা শুধু মুসলিমদের নয়, গোটা বিশ্বমানবতার অস্তিত্বের জন্যই এক বড় চ্যালেঞ্জ।
মন্তব্য করুন