ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার চলমান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে এক ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। বিশেষ করে তেহরানের সামরিক, পারমাণবিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামোর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা—কেবল কৌশলগত কোনো হামলা নয়, বরং একটি স্পষ্ট বার্তা বহন করে। ইসরায়েল চাইছে ইরানকে দুর্বল করতে, তার পরমাণু কার্যক্রম ধ্বংস করতে এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনৈতিক দুর্বলতাসহ নানা সংকটে জরাজীর্ণ। দেশটির চলমান শাসনব্যবস্থার প্রতিও জনসংখ্যার একটি বড় অংশের ক্ষোভ রয়েছে। মাত্র কিছুমাস আগেই বড় ধরনের বিক্ষোভ কোনো রকম দমন করে টিকে যায় সরকার। এমন অবস্থায় নেতানিয়াহু ভেবেছিলেন তেহরানের ওপর হামলার এখনই মোক্ষম সময়। এটি ইসরায়েলকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সহযোগিতা করবে। তবে তেলআবিবের সেই হিসেবে ছিল মারাত্বক ভুল।
ইসরায়েলের হামলা বাস্তবে ইরানিদের ঐক্যবদ্ধ করছে। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত ইরানিদের ক্ষুদ্ধ করেছে এবং জনগণের অভ্যন্তরীণ সংহতি বাড়াচ্ছে। এই আঘাত ইরানিদের এতটাই মজবুত করছে যা হয়তো নেতানিয়াহুর কল্পনাকেও ছাপিয়ে গেছে।
ইসরায়েল বহুদিন ধরেই ইরানের বিরুদ্ধে ‘প্রক্সি ওয়ার’, সাইবার যুদ্ধ এবং টার্গেট কিলিং পরিচালনা করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের তিন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড তাদের নতুন পর্যায়ের এক আক্রমণচিত্র তুলে ধরেছে। তেহরানের সরকারি দপ্তরে সাইবার হামলা, জাতীয় টিভির সম্প্রচারে বাধা, এবং সামরিক ঘাঁটিতে বিমান হানা—সব মিলিয়ে ইসরায়েল একটি পূর্ণাঙ্গ ‘হাইব্রিড ওয়ার’ শুরু করেছে।
তেল আবিবের এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য—ভেতর থেকে ইরানকে দুর্বল করে তার শাসনব্যবস্থা ভেঙে ফেলা। ইসরায়েল মনে করে, যদি সরকার পড়ে যায়, তাহলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিও থেমে যাবে। কারণ তারা জানে, ৫০০ মিটার গভীরে থাকা নাতাঞ্জ বা ফোরদোর মতো পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কেবল মার্কিন বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমার মাধ্যমেই ধ্বংস করা সম্ভব। আর সে ক্ষমতা ইসরায়েলের নেই।
ইসরায়েল বারবার দাবি করেছে, এ যুদ্ধ ইরানি জনগণের বিরুদ্ধে নয়; এটি দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই প্রচারণা এখন বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি। কারণ, যেই মুহূর্তে বিদেশি শক্তি দেশের ভেতরে হামলা চালায়, তখন ইরানিরা ‘শাসক বনাম জনগণ’ বিতর্ক ভুলে গিয়ে ‘জাতি বনাম আগ্রাসনকারী’ ইস্যুতে এক হয়।
ইরানের জনগণের মধ্যে বিরোধী মত বহুদিন ধরেই ছিল—বিশেষ করে ২০২২ সালের ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনের সময় তা ব্যাপকভাবে সামনে আসে। কিন্তু এখন সেই আন্দোলনের নেতারাও সরাসরি বলেন, ‘বিদেশি আগ্রাসনের পক্ষে নয়, বরং আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্বের পক্ষে।’
তেহরানে মুহুরার্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্যেই লাখ লাখ মানুষকে ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে জড়ো হতে দেখা গেছে। অন্যান্য শহরেও রাজপথে নেমেছেন ইরানিরা। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সরকারের পক্ষে শ্লোগান দিচ্ছেন তারা। শুধু রাজপথে নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং বুদ্ধিজীবী মহলেও দেখা যাচ্ছে সরকারের প্রতি সংহতি। সাবেক বিচারপতি মোহসেন বোরহানি লিখেছেন, ‘আমি সেই সেনার হাত চুম্বন করি, যে আমাদের ভূমি রক্ষা করছে।’ কিংবদন্তি ফুটবলার আলি দাই বলেছেন, ‘দেশদ্রোহী হওয়ার চেয়ে দেশের জন্য মরাটাই শ্রেয়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের হামলা সরকার পতনের সুযোগ তৈরি না করে উল্টো দেশটির জাতীয় ঐক্যকে জাগিয়ে তুলেছে। এমনকি পশ্চিমে থাকা বিরোধী নেতারা—যেমন রেজা পাহলভি, যাদের লক্ষ্য ছিল শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন, তারাও এখন সংকটে। কারণ, ইরানিরা অনুভব করছেন, এ যুদ্ধ শুধুই রাজনৈতিক নয়, বরং এটি একটি অস্তিত্বের লড়াই।
সরকারবিরোধী আন্দোলনের অনেকেই এখন বলছেন, শাসন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এখন আমাদের সবার আগে দেশকে রক্ষা করতে হবে। এই মনোভাব ইরানি সমাজে একধরনের ‘সংকটকালীন সংহতি’ তৈরি করেছে। এমনকি যাঁরা সংস্কারপন্থী বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী, তাঁরাও এখন বিদেশি হুমকিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ইরান বহুবার বিদেশি আগ্রাসনের মুখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ১৯৫৩ সালের সিআইএ-সমর্থিত মোসাদ্দেক পতনের পরও একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। ১৯৮০ সালে ইরাক যখন ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তখন লাখ লাখ তরুণ স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিও সেই জাতীয়তাবাদী চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল যদি ভেবে থাকে যে বাহ্যিক আঘাত বা সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে ইরানিদের শাসনের বিরুদ্ধে উসকানো যাবে, তাহলে তারা হয়তো ইরানিদের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব ভুল বুঝেছে। ইরানিদের কাছে দেশ আগে, তারপর সরকার। আগ্রাসন যত বড়ই হোক, তা যদি বিদেশি হয়, তাহলে ভিন্নমতগুলোও এক ছাতার নিচে চলে আসে।
এই বাস্তবতায় ইসরায়েলের কৌশল শুধু ব্যর্থ নয়, বরং উল্টো ফলপ্রসূ হচ্ছে। শাসনব্যবস্থা আরও দৃঢ় হচ্ছে, জনগণের মনোভাবে পরিবর্তন আসছে, এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইরান একটি ‘আক্রমণের শিকার রাষ্ট্র’ হিসেবে সহানুভূতির জায়গা তৈরি করছে। বলাই বাহুল্য, ইরানকে দুর্বল করতে গিয়ে ইসরায়েল বরং এক নতুন ইরানকেই শক্তিশালী করে তুলছে—যেটি আরও ঐক্যবদ্ধ, জাতীয়তাবাদী এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে প্রস্তুত।
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন