ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা ছিল ইরানে দীর্ঘদিন ধরে চলা মোসাদের গুপ্তচর নেটওয়ার্কের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। টার্গেট করা হয়েছিল ইরানের সামরিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু বিজ্ঞানীদেরও। এসব তথ্য মোসাদ সংগ্রহ করেছে এমনসব লোকের মাধ্যমে, যারা ইরানের নিজস্ব নাগরিক।
এখানেই শুরু ইরানের আতঙ্ক। কারণ শত্রু যদি বাইরের হয়, তাহলে চেনা সহজ। কিন্তু যখন শত্রু নিজের দেশেরই ভেতরে, নিজের পরিচয়ে- তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিক্রিয়া হয় আরও তীব্র, আরও দমনমূলক।
কার্যকর হওয়া ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিশ্ববাসী যতই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলুক না কেন, ইরানের অভ্যন্তরে এখন এক ভয়ের বাতাস বইছে। যুদ্ধক্ষেত্রের গোলাগুলি থেমেছে, কিন্তু শুরু হয়েছে নতুন এক যুদ্ধ- নিজেদের জনগণের বিপক্ষে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ চলাকালে ইরানের নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে ইসরায়েলের প্রবেশ বড় এক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মোসাদের সফল অনুপ্রবেশ তেহরানের ভেতরে চরম সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে। এই সুযোগেই সরকার ভিন্নমত দমনে নামে আরও কঠোর হাতে।
মঙ্গলবার (২৪ জুন) সংবাদমাধ্যম বিবিসি পারসিয়ান তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটির কেরমানশাহ প্রদেশের সরকারি কৌঁসুলি হামিদরেজা কারিমি জানিয়েছেন, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্ন’ ঘটানোর অভিযোগে ১১৫ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন ইউরোপীয় নাগরিক রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে সরাসরি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে।
কারিমি আরও জানান, আটকদের ছোট একটি অংশ গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেপ্তার হলেও, অধিকাংশের অপরাধ হচ্ছে-‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা’, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট, বিদেশি সংযোগ রাখা বা সরকারের সমালোচনার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
গত কয়েক দিনে কমপক্ষে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। যদিও তাদের নাম ও মামলা সংক্রান্ত বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। অন্যদিকে, দেশজুড়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও ডজনখানেক নাগরিক- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকার অভিযোগে।
এই দমননীতিকে আরও আইনগত শক্তি দিতে ইরানের পার্লামেন্ট সম্প্রতি একটি সংশোধিত আইন পাস করেছে, যা গুপ্তচরবৃত্তি মামলার দ্রুত বিচার এবং কঠোর সাজা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
ইরানের বিচার বিভাগের মুখপাত্র বলেন, আগের আইনে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে কার্যকর বিচার সম্ভব ছিল না। এখন পার্লামেন্ট আমাদের সেই ক্ষমতা দিয়েছে, যাতে ‘উদাহরণস্বরূপ শাস্তি’ দেওয়া যায়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইরান সরকার যুদ্ধের আবহকে ব্যবহার করছে ভিন্নমত ও নাগরিক স্বাধীনতা রুদ্ধ করার হাতিয়ার হিসেবে। তারা এটিকে ‘প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ’ নয়, বরং ‘প্রতিশোধমূলক দমননীতি’ বলে অভিহিত করছে।
প্রসঙ্গত, ইরানে সংস্কারের ডাক বহু পুরনো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশটির ইতিহাসে প্রতিটি সংকটই পরিণত হয়েছে আরও কঠোর শাসনের পটভূমিতে। যুদ্ধবিরতির পর শত্রুর হাত থেকে হয়তো রক্ষা পেয়েছে ইরান, কিন্তু সাধারণ মানুষ আজ নিজেদের দেশেই পড়েছে নতুন এক লড়াইয়ের মুখে- এক শ্বাসরুদ্ধকর, ভয়মিশ্রিত দমন-পীড়নের লড়াই।
মন্তব্য করুন