ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলা সংঘাত বিশ্বকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। যখন ক্ষণে ক্ষণে যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছিল, তখনই ১২ দিনের সংঘাতের অবসান এল স্বস্তির নিশ্বাস হয়ে। দুই দেশের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েল—তিন পক্ষকেই বিজয়ের দাবি করার সুযোগ এনে দিয়েছে।
দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলার সপ্তাহান্তে যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ অভিযান চালিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ যোগ দেয়। তার আগে ইরান নিজের উৎপাদিত অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েল গর্বের প্রতীক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেয় এবং মুহুর্মুহু হামলা করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ও জনগণকে নাজেহাল করে ছাড়ে। আবার ইসরায়েলও ইরানের আকাশ দখল করে নিজ বিমানবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
তবে নাটকীয়ভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করলেন যে তেল আবিব ও তেহরান একটি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। এদিকে যুদ্ধবিরতির কয়েক মিনিট আগে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি শহরগুলিতে আঘাত করলেও, এই দফায় হামলা তেহরানের শেষ মুহূর্তের সাহসিকতার প্রদর্শন বলে মনে হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধবিরতি এখন তিনটি দেশই যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েল—জয় দাবি করার অবস্থানে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করতে পারে যে, এতে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা কমেছে; ইসরায়েল বলছে - তেহরানের দুর্বলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে আর ইরান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং পিছু না হটার গর্ব করতে পারে।
আধুনিক যুদ্ধের একটি মূল দিক হলো, অভ্যন্তরীণ বার্তা এবং দেশের প্রচারমাধ্যম জনগণকে তাদের জয়ের বিষয়টি বোঝাতে সচেষ্ট থাকে। আর ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র - তিন দেশই এখন তাদের জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, জয় তাদেরই হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল
সংঘাত শুরুর পর থেকে কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলা যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ কৌশল বদলায়। গত শনিবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের দস্যু’ বলে আখ্যা দিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যদি তেহরান শান্তির পথে না আসে, তবে পরবর্তী হামলা হবে আরও ভয়াবহ।’ ঠিকই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ৩ পারমাণবিককেন্দ্রে হামলা করে বসে।
হামলার পর ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন জানত, সংঘাত কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।
দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকারক হবে, ট্রাম্প এটা বুঝতে পারেন। তেহরানের এমন একটা পথ দরকার, যাতে তারা উত্তেজনার পথ থেকে সরে আসতে পারে, আবার দেশের অভ্যন্তরীণ জনসমর্থনও না হারায়—এমনটা অনুভব করে ইরান কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর ট্রাম্প পাল্টা হামলায় যাননি। উল্টো ইরানকে আগাম সতর্কতার জন্য ধন্যবাদ দেন।
যুদ্ধের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ইরানে বোমা হামলার জন্য নিজ দেশেই সমালোচনার মুখে পড়া ট্রাম্প এখন নিজেকে শান্তির দূতের ভূমিকায় তুলে ধরতে পারছেন। এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সেনা হারায়নি, নিজেদের সামরিক শক্তি দেখিয়েছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও দাবি করতে পারছে—এ যেন ট্রাম্পের জন্য কৃতিত্ব দাবির মোক্ষম সময় হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে তাকে নোবেল পুরস্কারের জন্যও মনোনীত করা হয়েছে।
ইসরায়েলের দাম্ভিকতা ও আত্মগর্ব
যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান হামলার আগের সপ্তাহেই ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে আকাশে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তারা ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায় এবং তেহরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে।
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাত ইরান-ইসরায়েলের হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অর্জন এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িয়ে পড়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে চালানো বিমান হামলা শুধু তেহরান নয়, তারা পুরো বিশ্বকে এই বার্তা দিয়েছে যে ওয়াশিংটন নিরঙ্কুশভাবে তেল আবিবের পাশে আছে।
ভূরাজনৈতিকভাবে এই অবস্থান ইসরায়েলের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল করেছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও জনগণের কাছে এর প্রভাব পড়বে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এটি এক বড় রাজনৈতিক লাভ এনে দিতে পারে।
মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি করেন, ইরানে পরিচালিত সামরিক অভিযানের সব লক্ষ্য ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে।
বিশ্বকে ইরানের ‘প্রতিরোধ’ বার্তা
ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিমান হামলা তেহরানকে এক জটিল সমীকরণে ফেলে দেয়। বারবার ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ইরানের প্রতিশোধ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে, কিন্তু প্রতিপক্ষ যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। একদিকে মুখ রক্ষা, অন্যদিকে উত্তেজনা থেকে সরে আসার পথ—দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে হতো ইরানকে। ইরান সে পথেই হেঁটেছে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নির্দেশ দেন যে, ইরানকে পাল্টা আক্রমণ করতে হবে, কিন্তু সংঘাত যাতে আরও না ছড়িয়ে পড়ে।
মার্কিন ঘাঁটিগুলোয় হামলা করে ইরান আন্তর্জাতিকভাবে এমন এক উজ্জল ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে, মাথা নিচু করেনি, পিছু হটেনি।
এ ছাড়া যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত তেহরান ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং শেষ মুহূর্তের সাহসিকতার প্রদর্শন করে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তার দেশের বিরুদ্ধে চালানো এই যুদ্ধ মূল লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলছি না যে তারা কোনো ক্ষতি করতে পারেনি—হ্যাঁ, কিছু ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু তারা আমাদের সব ধরনের সক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার বা অন্য যেকোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা অর্জন করতে পারেনি।’
সূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস ও এনডিটিভি
মন্তব্য করুন