ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে বিপর্যস্ত গাজা উপত্যকায় মানবিক বিপর্যয় ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, গাজা এখন শিশুদের কবরস্থান ও অনাহারের উপত্যকায় পরিণত হয়েছে।
শুক্রবার (১১ জুলাই) আলজাজিরার একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার-জেনারেল ফিলিপ ল্যাজারিনি এক্সে লেখেন, ইসরায়েল গাজায় একটি নিষ্ঠুর ও পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের ফাঁদ তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, ‘গাজার মানুষ এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে তাদের সামনে বেছে নেওয়ার মতো মাত্র দুটি পথ রয়েছে। ক্ষুধায় মারা যাওয়া অথবা গুলিতে প্রাণ হারানো।’
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ৮১৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন কেবল খাদ্য সহায়তা সংগ্রহের সময়। এর মধ্যে অন্তত ৬৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে মার্কিন ও ইসরায়েল সমর্থিত এনজিও জিএইচএফ পরিচালিত বিতরণকেন্দ্রের আশপাশে।
শুক্রবার গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকায় খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ১৫ জন ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে ৯ জন শিশু ও ৪ জন নারী। একই দিন রাফাহ শহরে সহায়তা সংগ্রহের সময় আরও অন্তত ১১ জন নিহত হন।
জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের মুখপাত্র রবিনা শামদাসানি বলেন, ‘মে মাস থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৭৯৮ জন খাদ্য সংগ্রহের সময় প্রাণ হারিয়েছেন।’
জিএইচএফের সঙ্গে যুক্ত মার্কিন ঠিকাদার ও ইসরায়েলি সেনারা স্বীকার করেছেন যে, তারা কখনও কখনও নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করেছেন, যারা খাবারের আশায় জড়ো হয়েছিলেন। (ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ এবং অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস)
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) উপপ্রধান কার্ল স্কাউ গাজার পরিস্থিতিকে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি জানান, গাজার জনসাধারণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুদ রয়েছে, কিন্তু এসব ত্রাণ ট্রাক দিয়ে গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে বিতর্কিত জিএইচএফ কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভর করছে।
একই সময় ইসরায়েল গাজায় একটি তথাকথিত ‘মানবিক শহর’ গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। বিশ্লেষকরা একে আরেকটি ‘নাকবার’ (১৯৪৮ সালের গণবিপর্যয়) সম্ভাবনার সঙ্গে তুলনা করছেন।
স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাফাহ শহরের বিস্তীর্ণ অংশ গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে, যেখানে ভবিষ্যতে গাজার ২১ লাখ মানুষকে স্থানান্তর করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাতজ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল লেভি বলেন, ‘জিএইচএফ-এর সাহায্যকেন্দ্রগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে ফিলিস্তিনিরা বাধ্য হয়ে রাফাহ অভিমুখে সরতে হয়। আমরা যেন আরেকটি নাকবার পথ দেখছি।’
ইসরায়েলি হামলায় শুক্রবার জাবালিয়া এলাকায় একটি স্কুলে আটজন নিহত হন, যেটি বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। তুফাহ এলাকার একটি বাড়িতে হামলায় নিহত হয় একটি শিশু।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকটে হাসপাতালগুলো কার্যত অচল। অনেক জরুরি সেবা বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স চলাচলও। ফলে আহতদের গন্তব্যে নিতে হচ্ছে গরুর গাড়ি বা পশুবাহনে।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক বলেন, ‘মানবিক সহায়তা অবরুদ্ধ থাকায় প্রতিদিন গাজায় শিশু ও সাধারণ মানুষ ক্ষুধায় ও গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে। একটি অবিলম্বিত যুদ্ধবিরতি ছাড়া এই মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব নয়।’
মন্তব্য করুন